ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষিত

চট্টগ্রামে করোনা রোগী ভর্তি করছে না বেসরকারী হাসপাতাল

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ৪ জুন ২০২০

চট্টগ্রামে করোনা রোগী ভর্তি করছে না বেসরকারী হাসপাতাল

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সরকারী কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রামে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকরা এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত রোগী ভর্তি করানো থেকে বিরত। শুধু তাই নয়, সাধারণ অসুস্থ রোগীও ‘করোনামুক্ত’ সার্টিফিকেট ছাড়া বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে পারছেন না। স্থানীয় বিভিন্ন মহলের প্রতিনিধিগণ এ প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতকে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো রীতিমত জিম্মি করেছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছেন। অপরদিকে, স্বাস্থ্য বিভাগ এ ঘটনায় রীতিমত অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। এ সংক্রান্তে যে মনিটরিং কমিটি গঠিত হয় এবং পুলিশ প্রশাসন এ জাতীয় ঘটনা নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সবই নামমাত্র বলে আলোচনা চলছে। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যতই বাড়ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে ততই শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বাড়ছে। সর্বত্র ভীতিকর পরিস্থিতি করোনা এবং করোনা উপসর্গ নিয়ে। মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা না পেয়ে অনেকের প্রাণহানি ঘটছে। ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়ায় শিল্পপতি, উঁচুমাপের ব্যবসায়ী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত এই চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এ ধরনের বেহাল দশা সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের করোনা সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসা প্রদান থেকে বিরত থাকা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৪০৩। মৃত্যুবরণ করেছে ৮০। হাসপাতাল ও বাসায় আইসোলেশনে থেকে সুস্থ হয়েছেন ৯৯৫। চট্টগ্রামে আইসিইউ সুবিধাযুক্ত বেড রয়েছে মাত্র ৩৫০। অথচ, করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। ইতোমধ্যে আইসিইউ সুবিধা না পেয়ে অনেকের মৃত্যু বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো করোনা রোগী চিকিৎসায় যুক্ত হলে এমন চিত্র প্রকাশ পেত না বলে অনেকের অভিযোগ। সরকার দেশের সকল প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিককে করোনা সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে নির্দেশনা প্রদান করেছে। কিন্তু চট্টগ্রামে তা মানা হচ্ছে না। বেসরকারী হাসপাতাল ও মালিকদের সঙ্গে বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক মত দেয়ার পরও তারা নেতিবাচক ভূমিকায় রয়েছে। ফলে করোনা সংক্রমিত রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন। এর মূল কারণ প্রচ- শ^াসকষ্ট এবং এ শ^াসকষ্টের সময় আইসিইউ সুবিধা না পাওয়া। এ ছাড়া প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে করোনামুক্ত সার্টিফিকেট দেখানোর নিয়ম চালু করেছে। এতেও সাধারণ রোগীরা ভোগান্তির চরমে রয়েছেন। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষীয় বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, করোনা রোগী ভর্তি করানো হলে গোটা হাসপাতাল বা ক্লিনিকে অন্য কোন রোগী চিকিৎসা নিতে আসবে না। এছাড়া একজন করোনা রোগী ভর্তি করা হলে এতে অন্যান্য রোগীর পাশাপাশি চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীরাও সংক্রমিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছ। ইতোমধ্যে এ জাতীয় ঘটনা ঘটেছে। ফলে তারা এ জাতীয় রোগী ভর্তি করানোর কাজ থেকে এখনও বিরত। বিভাগীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক বৈঠকে করোনা রোগী ভর্তি করানোয় মত দেয়া হলেও তারা কেন বিরত, তার কোন জবাব নেই। এছাড়া বিভাগীয় পর্যায়ের ওই বৈঠকের পর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিলÑ যেসব হাসপাতাল বা ক্লিনিক করোনা রোগী ভর্তি করাবে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের হুঁশিয়ারিও অকার্যকর হয়ে আছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান সবই কথার কথা। বর্তমানে এটা পরিষ্কার যে, বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর কাছে করোনাসহ অন্যান্য রোগীও রীতিমত জিম্মি। এর প্রমাণ অহরহ। হাসপাতাল প্রাঙ্গণগুলোতে প্রতিদিন কান্নার রোল পড়ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, চট্টগ্রামে নিজে এবং মায়ের চিকিৎসা না পেয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ হাসান শাহরিয়ার কবিরকে ঢাকায় চলে যেতে হয়েছে। করোনা সংক্রমিত হয়ে চিকিৎসা না পেয়ে এবং প্রয়োজনীয় আইসিইউ স্বল্পতার অভাবে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ যাদের মৃত্যু হয়েছে তা রীতিমত চট্টগ্রাম জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এদিকে, চট্টগ্রাম জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডাঃ সুশান্ত বড়–য়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বেসরকারী হাসপাতালগুলোকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। অনুরূপ অভিযাগ এনেছেন প্রকৌশলী সংগঠন নেতা দেলোয়ার হোসেন, ক্যাব নেতা নাজের হোসেনসহ অনেকে। করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাননি প্রখ্যাত এক আলেমও। অন্যদিকে, সরকারী হাসপাতালগুলোতে যারা দীর্ঘ অপেক্ষার পর ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন তারা কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীর অনেকের অবহেলাকে এ নিয়ে দায়ী করছেন। ফলে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেশন ও আইসিইউ সুবিধা বঞ্চিত হয়েও অনেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন। শিল্পপতি মোরশেদ আলম, চবি অধ্যাপক সাবরিনা ইসলাম সুইটি, প্রখ্যাত আলেম নুরুল ইসলাম হাশেমীর মৃত্যু এর অন্যতম উদাহরণ। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বিএমএ সাধারণ সম্পাদক ডাঃ ফয়সল ইকবাল চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারী- বেসরকারী চিকিৎসা কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা সমান করা না হলে এ নিয়ে ইতিবাচক সুফল আসার সম্ভাবনা তেমন নেই। চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার বর্তমান বেহাল চিত্রে শঙ্কিত নগরবাসী। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার অভিযোগ এসেছে এক্ষেত্রে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত বৈঠক ও নির্দেশনা অকার্যকর থাকার পরও কোন ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় সচ্ছলরা আগেভাগেই কিনেছেন এবং কিনছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার, ক্যানোলা, অক্সিজেন মাপার যন্ত্র এবং প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট ওষুধসামগ্রী। সংক্রমিত হলে বাসায় থেকে চিকিৎসা চালানোর নির্মিত্তেই আগেভাগে এমন ঘটনার অবতারণা বলে দিচ্ছে চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমানে কোন্ পর্যায়ে। উল্লেখ করা যেতে পারে, চট্টগ্রামে ছোটবড় ৩০টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে শুরুতে ১২টিতে চারধাপে করোনা চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ ঘোষণা দেয়। সর্বশেষ ইম্পেরিয়াল হসপিটাল ও ইউএসটিসির বঙ্গবন্ধু হাসপাতালকে শুধু করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য নির্দেশ দিলেও সবই অকার্যকর রয়েছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ার তালিকায় রয়েছে বিশিষ্ট ও প্রবীণ আইনজীবী মোঃ কবির চৌধুরী, আইনজীবী আবুল কাশেম চৌধুরীসহ অনেকেই। চট্টগ্রামে প্রায় ১৬ সংবাদকর্মী করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। এদের কয়েকজন চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। অবশিষ্টরা বাসায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিচ্ছেন চিকিৎসকদের পরামর্শে। বেসরকারী কোন হাসপাতাল কোন পেশার সংক্রমিত রোগী গ্রহণে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এদিকে, স্বাস্থ্য বিভাগ মহানগরীর বারো থানাকে করোনার রেড জোন ঘোষণা করেছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১শ’র ওপর হওয়ায় ১২ থানাকে রেড জোন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে কোতোয়ালি থানা শীর্ষে। এছাড়া পাঁচলাইশ, খুলশী, পতেঙ্গা, হালিশহর, ডবলমুরিং, বন্দর, পাহাড়তলী, ইপিজেড, চকবাজার ও চান্দগাঁও থানা এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
×