ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইউনাইটেড হাসপাতালে ফের করোনা ইউনিট চালু

নিহতদের লাইফসাপোর্টে রাখার কোন আলামত মেলেনি

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ৩০ মে ২০২০

নিহতদের লাইফসাপোর্টে রাখার কোন আলামত মেলেনি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বেসরকারী ইউনাইটেড হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু রহস্যের কিনারা হয়নি। অগ্নিকান্ডের সময় নিহত পাঁচজন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন বলে হাসপাতালের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে। যদিও হাসপাতালের এমন দাবি ভিত্তিহীন উল্লেখ করা হয়েছে নিহতদের পরিবারের তরফ থেকে। তদন্তকারী সংস্থা পুলিশও বলছে, আইসোলেশন সেন্টারে লাইফ সাপোর্ট দেয়ার মত সব উপকরণ ছিল। তবে নিহত পাঁচ জনকে লাইফ সাপোর্টে রাখার কোন আলামত প্রাথমিক তদন্তে মেলেনি। ইতোমধ্যেই নিহতদের মধ্যে দুইজনের করোনা নেগেটিভ এসেছে। ফলে তাদের লাইফ সার্পোট নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে নিহতদের পরিবারের তরফ থেকে এক বা একাধিক মামলা দায়ের হতে পারে বলে সূত্র বলছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের দায়ের করা মামলাটি পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও সিআইডিসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তদন্ত করে দেখছে। আইসোলেশন সেন্টার করার সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সেখানে চিকিৎসাধীন রোগীদের তরফ থেকে বাধা দেয়া হয়েছিল। এরপর সরকারের নির্দেশে দায়সারা গোছের আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছিল। তদন্তকারীরা সেটিকে আইসোলেশন সেন্টারের নামে অন্ধকার কুঠুরি বানানো হয়েছিল দাবি করেছেন। করোনা চিকিৎসা শুরুর পর হাসপাতালটিতে রোগীর সংখ্যা কমে যায়। এতে করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য পরিকল্পিতভাবে কেউ ব্যক্তিগত বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা তা তদন্ত করছে পুলিশ। গত ২৭ মে বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাসপাতালটির বাউন্ডারির ভেতরে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় স্থাপিত আইসোলেশন সেন্টারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট রাত ১০টার খানিকটা পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ততক্ষণে মাত্র পাঁচ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেখানে থাকা রিয়াজুল আলম (৪৫), খোদেজা বেগম (৭০), ভেরন এ্যান্থনী পল (৭৪), মনির হোসেন (৭৫) ও মাহাবুব এলাহী চৌধুরী (৫০) নামের পাঁচজনের মৃত্যু হয়। হাসপাতালের তরফ থেকে ফায়ার সার্ভিসকে বিষয়টি জানানো হয়নি। জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে রোগীর এক স্বজন ঘটনা জানায় ফায়ার সার্ভিসকে। ঘটনার রাতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে গুলশান মডেল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) শেখ শাহানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এটিকে আইসোলেশন সেন্টার বলা যাবে না। আইসোলেশন সেন্টারের নামে সেখানে একটি অন্ধকার কুঠুরি তৈরি করেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য হওয়ায় কোনমতে একটি আইসোলেশন সেন্টার করেছিল। মূলত এটি সরকারকে দেখানো হয়েছিল যে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকরের নির্দেশ মানছে। একটি রুমের ভেতর দিয়ে আরেকটি রুমে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল একটি অন্ধকার কুঠুরি। তিনি আরও জানান, করোনা রোগীদের জন্য আইসোলেশন সেন্টারে লাইফ সার্পোট দেয়ার মতো যন্ত্রপাতি দেখা গেছে। তবে প্রাথমিক তদন্তে নিহত পাঁচ রোগীকে যে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তার প্রমাণ মেলেনি। এছাড়া নিহত পাঁচজনের মধ্যে দুইজনের করোনা নেগেটিভ ছিল। তাহলে তাদের লাইফ সাপোর্টে রাখার বিষয়টি প্রশ্নের জন্ম দিবে এটিই স্বাভাবিক। আর তারা যদি করোনা পজিটিভ না হয় এবং গুরুতর অসুস্থও হয়ে থাকে তাহলে তাদের কেন আইসোলেশন সেন্টারে রেখে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হলো। তাদের তো হাসপাতালের মূল ভবনে নিয়ে চিকিৎসা করতে কোন অসুবিধা ছিল না। তাদের আইসোলেশন সেন্টারের পাশেই থাকা আইসিইউতে নিয়ে লাইফ সাপোর্ট দিতে পারতো। সেটি তো হয়নি। নানা বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনাটি পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করে দেখছে। সিআইডির ফরেনসিক টিম মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই নিহতদের পরিবারের তরফ থেকে হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এক বা একাধিক মামলা দায়ের হতে পারে। এদিকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে হাসপাতালের তরফ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, নিহতরা সবাই আইসোলেশন সেন্টারে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। রাতেই এর প্রতিবাদ করেছেন নিহতদের স্বজনরা। ঘটনার রাতেই ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, এ ধরনের একটি হাসপাতালে যে ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার কথা তা নেই। ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলেও তা ব্যবহার করতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ব্যবহার করার মতো জনবল ছিল না। হাসপাতালটিকে সচেতন করতে অগ্নিনির্বাপণের মহড়াও দেয়া হয়েছে সেখানে। এ ঘটনায় গঠিত ফায়ার সার্ভিসের গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন জানান, সরকারের নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকার কারণে আইসোলেশন ইউনিটটি দায়সারা গোছের করে গড়ে তোলা হয়েছিল। এ ধরনের আইসোলেশন সেন্টার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যে পাঁচজন মারা গেছেন তারা সানসেটের ঠিক নিচে ছিলেন। আর বাইরে একটা এক্সটেনশন আছে টিনশেডের। অস্থায়ীভাবে তৈরি ওই ইউনিটের পার্টিশনগুলো তৈরি করা হয়েছিল পার্টেক্স জাতীয় বোর্ড দিয়ে। যা অত্যন্ত দাহ্য। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম জানান, সিআইডির ফরেনসিক টিম হাসপাতালটি থেকে ১২টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বের করে আনে। যার মধ্যে আটটিরই মেয়াদ নেই। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, আগুন নেভাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তৎপর ছিল না। কোভিড-১৯ রোগীকে ‘চলে যেতে চাপ দিচ্ছে’ ইউনাইটেড ॥ এদিকে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে করোনাভাইরাস আক্রান্ত এক রোগীকে অন্য কোথাও চলে যেতে চাপ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই রোগী এখন শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এবং তার অক্সিজেন লাগছে বলে জানিয়েছেন। এদিকে ঢাকার সব হাসপাতাল ঘুরেও তার জন্য একটি আইসিইউ বেড না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন স্ত্রী। কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে এই হাসপাতালে ভর্তি হন রাজধানীর কুড়িল চৌরাস্তা এলাকার বাসিন্দা সুলতান মিয়া। তিনি শুক্রবার রাতে জানান, সপ্তাহখানেক আগে তার জ্বর আসে। জ্বর না কমা এবং সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় বুধবার ইউনাইটেড হাসপাতালে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। পরীক্ষায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হলে বৃহস্পতিবার এখানে ভর্তি হন তিনি। তাকে ‘অবজারভেশন ওয়ার্ডে’ রাখা হয়েছে। সুলতান মিয়া বলেন, ‘আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে জানিয়ে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই আমাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়া হচ্ছে। ইউনাইটেডে ফের করোনা ইউনিট চালু ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরকে না জানিয়ে হাসপাতালের বর্ধিত অংশে করোনা ইউনিট চালু করেছিল ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচজন রোগীর মৃত্যুর পর মূল ভবনের ছয়তলায় চালু হয়েছে করোনা ইউনিট। এখন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবা দেয়া বা করোনা ইউনিট চালু করতে বলা হয়েছে। যেকোন হাসপাতালের বেডের সংখ্যা বাড়াতে হলে অনুমতি নিতে হয়। এসব কক্ষ তৈরির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। কিন্তু হাসপাতালটিতে বেডের সংখ্যা বাড়ানোর কোন অনুমতি নেয়নি। ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের বর্ধিত অংশ জোড়াতালি দিয়ে এ ধরনের ইউনিট করেছে। তবে শুক্রবার ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিকেশন্স এ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ডাঃ সাগুফা আনোয়ার জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুসারে মূল ভবনের ৬ তলায় আজ থেকে আবার করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা চালু করা হয়েছে।
×