ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় মোটেও জমেনি কেনাকাটা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আগামী মাস থেকে ব্যবসায় গতি ফিরে আসবে বলে আশাবাদী ব্যবসায়ীরা দোকানদার, ব্যবসায়ীদের প্রণোদনার আওতায় আনার দাবি

ঈদ বাণিজ্যে ধস

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ২৩ মে ২০২০

ঈদ বাণিজ্যে ধস

এম শাহজাহান ॥ করোনা ঝুঁকি নিয়ে জীবিকার তাগিদে মার্কেট শপিংমল চালু হলেও জমেনি ঈদের কেনাকাটা। কাক্সিক্ষত ক্রেতা না পেয়ে হতাশ ব্যবসায়ীরা। তবে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে ঈদের পর জুন মাস থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাভাবিক গতি ফিরে আসবে বলে আশাবাদী তারা। ওই সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রেতাদের মার্কেটমুখী করার উদ্যোগ নেয়া হবে। চলমান করোনা পরিস্থিতি দেশের মানুষের ঈদ আনন্দ মাটি করে দিয়েছে। করোনাকালে বেঁচে থাকাটা এখন নতুন চ্যালেঞ্জের নাম। এ অবস্থায় ঈদ কেনাকাটায় আগ্রহ নেই সাধারণ মানুষের। ফলে গত ১০ মে থেকে সরকার দোকান পাট, মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতানগুলো খোলার অনুমতি দিলেও তাতে ভোক্তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি মার্কেট চালু করার সুযোগ পেয়েও করোনা সংক্রমণ রোধ করতে বড় বড় শপিংমলগুলো বন্ধ রেখেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এখন টুকটাক নিত্যপণ্যের কেনাকাটা চলছে মার্কেট থেকে মার্কেটে। এদিকে, করোনা আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা ও হতাশা বিরাজ করছে। কেনাকাটা করার মতো এক শ্রেণীর মানুষের হাতে টাকা পয়সা থাকার পরও অনেকে মার্কেটে যাচ্ছেন না। আবার করোনার কারণে কেনাকাটা করার মতো সাধারণ মানুষের হাতে পর্যাপ্ত অর্থকড়িও নেই। ফলে এই সঙ্কটের মধ্যে ঈদের মার্কেট জমার আর কোন সম্ভাবনা দেখছে না বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, সবার কাছে তার জীবন আগে। করোনা ঝুঁকি নিয়ে ক্রেতারা মার্কেটে আসছেন না। আর এ কারণে সীমিত পরিসরে কিছু দোকান, মার্কেট ও শপিংমল চালু হলেও কেনাকাটা নেই। ব্যবসায়ীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা এখন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশায় আছেন। জুনের মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসলে সব দোকানপাট খুলে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনার আওতায় দোকানদার ব্যবসায়ীদের আনতে হবে। জানা গেছে, করোনায় বিপর্যয় নেমে এসেছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে। ঈদের মতো উৎসব কেন্দ্রিক বাণিজ্যও এর বাইরে নয়। ঈদ ঘিরে প্রতিবছর দেশে বিভিন্ন খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। এবারে সেই বাণিজ্যে ধস নেমে গেছে। এর আগে লকডাউনের মুখে বাংলা নববর্ষের ব্যবসা করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপের ফলে দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত রেমিটেন্সও পর্যুদস্ত। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসী। অনেকেই এরই মাঝে শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন। যারা বিদেশে অবস্থান করছেন তারাও টাকা পাঠাতে পারছেন না। এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ঈদের কেনাকাটায়। অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমান ঈদ বাজারের অবস্থা অন্য বারগুলোর মতো নয়। সীমিত পরিসরে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলেও জমেনি ঈদ বাজার। অধিকাংশ দোকানপাট-শপিংমল বন্ধ। যে কয়টি খুলেছে করোনা আতঙ্কে সেগুলোতেও ক্রেতা সমাগম সেভাবে নেই। বেচাবিক্রি না থাকায় হতাশ বিক্রেতারা। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার কারণে এবারের ঈদ বাজার হবে অর্থনীতির জন্য নিরাশার। এ বছর ঈদে লাখ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, যারা ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যদিও সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে অল্প সংখ্যক দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে খুবই সীমিত পর্যায়ে। এই মুহূর্তে ঈদ উদ্যাপনে কেনাকাটার মানসিকতা নেই মানুষের। ফলে এ বছর ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি বহুলাংশে থমকে গেছে। ঈদ ঘিরে ইতোমধ্যে যে বিনিয়োগ হয়েছে তাও উঠে আসবে না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিপণিবিতানগুলো। এরপর রয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। এদিকে, সবকিছু বন্ধ থাকায় বাংলাদেশ কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সম্প্রতি তার একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক। তাদের মতে, সাধারণ ছুটিতে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে গড়ে মোট অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ দিনে কমপক্ষে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৩১ দিনের অবরুদ্ধ অবস্থায় অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মে মাস শেষে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের মোট দেশীয় উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ। জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি প্রবাহ পাল্টে গেছে। সীমিত পরিসরে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেও জমেনি ঈদ বাজার। তবে যে কয়টি দোকান খুলেছে তাতেও নেই ঈদের আমেজ। করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর কিছুটা ভিন্নভাবেই দিনটি উদ্যাপন করতে হবে দেশবাসীকে। তাই বেচাবিক্রি না থাকায় হতাশার কথা জানিয়েছেন বিক্রেতারা। এ প্রসঙ্গে এলিফ্যান্ট রোডের কিংস ফ্যাশনের স্বত্বাধিকার আবু নাসের মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদ কেনাকাটায় এবার নগরবাসীর কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। প্রতিবছর ঈদের পনেরো দিন আগে দম ফেলার সময় পাওয়া যায় না। আর এবার ক্রেতাশূন্য দোকানে মাছি মারতে হচ্ছে। এর আগে ঈদের দিন যত এগিয়ে আসত ততই নগরীর মার্কেটগুলোয় ভিড় বাড়ত। এ বছর সেই চিত্র দেখা যায়নি। করোনা আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না অনেকেই। তবে যারা কেনাকাটার জন্য বের হচ্ছেন তাদের মধ্যেও যথেষ্ট সাবধানতা দেখা যাচ্ছে। কেনাকাটা করলেও বেশি সময় ব্যয় করছেন না তারা। তবে মার্কেটগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। নিউমার্কেট সংলগ্ন এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে মার্কেটটি বন্ধ থাকলেও তার আশপাশের ফুটপাথগুলোতে কিছু দোকানপাট বসেছে। তবে তাতে ক্রেতাদের তেমন ভিড় নেই। ডাকাডাকি করেও তেমন একটা ক্রেতা পাচ্ছেন না খুচরা বিক্রেতারা। তাদের আশা ঈদের দিন ঘনিয়ে আসলে ক্রেতা সাধারণের ভিড় কিছুটা বাড়বে। গাউছিয়া ও চাঁদনি চক মার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে ঈদের পোশাকের অন্যতম এ মার্কেটটি বন্ধ রয়েছে। আশপাশে কয়েকটি ছোটখাটো দোকানপাট খুলেছে। এসব দোকানপাটের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন গত কয়েক দিনের তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার মতো তেমন বেচাবিক্রি হচ্ছে না। আগামী দুই-একদিন ক্রেতাদের সংখ্যা আরও কিছুটা বাড়বে। এ প্রসঙ্গে বিউটি ফ্যাশন হাউসের ম্যানেজার আবুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এখনও তেমন একটা বেচাবিক্রি নেই। আমাদের দোকানের ক্রেতাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। কিন্তু এখন তাদের অবস্থা তেমন একটা ভাল না। তারা মার্কেট করতে কম আসছেন। সারা দিনে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকারও বেচাকেনা হচ্ছে না। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড এলাকার পুরো মার্কেট না খুললেও কোথাও কোথাও ঈদের পোশাক কেন্দ্রিক কিছু মার্কেটের নিচ তলার দোকানপাট খুলতে দেখা গেছে। তবে বেচাবিক্রি তেমন নেই। এসব দোকানে যারা আসছেন তারা তেমন সামাজিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। আড়ংসহ যেসব বড় বড় শপিংমল খোলা রয়েছে সেসব মার্কেটে গ্রাহকদের উপস্থিতি রয়েছে। তবে বেচাকেনা কম। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রেতাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রবেশ করানোর দাবি করলেও সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদ ঘিরে অর্থনীতি ব্যবস্থাকে সচল করতে গিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে কতটা ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে সেটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন নতুন করে হাজারো মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে, এ অবস্থায় আমরা ঈদকে কেন্দ্র করে দোকানপাট খুলে একটা বড় ঝুঁকি নিয়েছি। এ বছর ঈদ স্বাভাবিক হবে না। তিনি বলেন, সরকার প্রায় লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সেগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার একটা ফান্ড দিয়েছে, সেখান থেকে নিঃশর্তে একটা অংশ একেবারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য দিতে হবে। আগামী তিন মাস। যাতে তারা চলতে পারে। পাশাপাশি করোনার পর তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যও পরিকল্পনা করতে হবে। এদিকে, ঈদ সামনে রেখে ইতোমধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বেচাবিক্রি কম হওয়ার কারণে তাদের সেই বিনিয়োগ এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সঙ্কট উত্তরণ ও বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
×