ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মধুমাসে আগের মতো মধু নেই, ঢাকার বাজারে অল্পস্বল্প ফল

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২০ মে ২০২০

মধুমাসে আগের মতো মধু নেই, ঢাকার বাজারে অল্পস্বল্প ফল

মোরসালিন মিজান ॥ দেশে সারাবছরই কিছু না কিছু ফল হয়। সে যতই হোক, জৈষ্ঠ্যের আলাদা মহিমা। গ্রীষ্মের দ্বিতীয় মাসে এসে গরম যেমন বাড়ে, তেমনি প্রাণ শীতল করার জন্য থাকে গাছ ভর্তি ফল। নানা জাতের সুমিষ্ট রসালো ফলের কারণে জৈষ্ঠ্যকে বলা হয় মধুমাস। বছর ঘুরে আবারও সে মাসটি এসেছে। এরই মাঝে পার হয়েছে কয়েকদিন। অন্যান্য বছর এ সময়টাতে রসালো ফলে বাজার ভরে ওঠতে দেখা যায়। এবার বাজারটাই উধাও! অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে নামমাত্র খোলা আছে দোকানপাট। ফলন ভাল হলেও, গাছ থেকে ফল পাড়া এবং পরিবহনের ঝক্কি বেড়েছে। এ অবস্থায় ঢাকার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে অল্পস্বল্প ফল। মধুমাসে আগের সেই মধু পাচ্ছেন না রাজধানীবাসী। মন তাই খারাপ। অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনা সঙ্কটের মধ্যেই বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকার বাদামতলী ও কাওরান বাজার আড়তে ঢুকছে কিছু কিছু ফল। পরে তা শহরের অলিগলির দোকানগুলোতে চলে যাচ্ছে। এতদিন যেসব দোকানিরা শুকনো আঙ্গুর আপেল মাল্টা নিয়ে বসে থাকত, তারা এখন লিচু আর আমকেই রাখছেন সবার ওপরে। কাঁঠাল আনারস তরমুজ বাঙ্গী জামরুল তালের শাশ ইত্যাদি ফলও টাটকা। গলির মুখ দিয়ে ঢোকার সময় মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে, করোনার মাঝেও ঠিক চলে এসেছে মধুমাস। সোমবার কাওরান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আগের সেই হাকডাক নেই। মূল বাজারে ঢোকার ও বের হয়ে আসার পথে কয়েকজন ফল বিক্রেতা ঝুরি নিয়ে বসেছেন। কার ফল কেন সেরা, মুখ ফুটে অতো বলতে যাচ্ছেন না। কোন কোন দোকানে একটি বা দুটি ফলের কিছু অংশ কেটে রাখা হয়েছে। ক্রেতা চাইলে চেখে দেখতে পারেন। তারপর কেনার প্রশ্ন। অবশ্য রোজা রেখে চেখে দেখার সুযোগ নেই। তাই চোখে দেখেই কিনছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। মধুমাসের প্রথম দিকে লিচুর চাহিদাই থাকে তুঙ্গে। রসালো এ ফল গত কয়েকদিন ধরে মোটামুটি বাজারে আছে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দুই জায়গার লিচু বিক্রি করছেন তারা। ঢাকার কাছে হওয়ায় আগেভাগে চলে এসেছিল সোনারগাঁওয়ের লিচু। জ্যৈষ্ঠ শুরুর আগেই বাজারে ওঠে গিয়েছিল। আকারে খুব বড় নয়। কিছুটা টক স্বাদের। এরপরও ভাল বিক্রি হচ্ছে। সোনারগাঁওয়ের এক শ’ লিচু বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। অন্যটি এসেছে ঈশ^রদী থেকে। এক শ’ লিচুর দাম আড়াই শ’ থেকে ৩০০ টাকা। ঈদের আগে আগে ময়মনসিংহ গাজীপুর কাপাসিয়া এলাকার লিচু বাজারে ওঠবে। অবশ্য চাহিদার তুঙ্গে দিনাজপুর ও রাজশাহীর লিচু। দারুণ মিষ্টি। রসালো। ঈদের পর এসব জাত বাজারে আসবে বলে জানান বিক্রেতারা। সবচেয়ে বড় আকারের মিষ্টি লিচুটি ‘বোম্বাই লিচু’ নামে পরিচিত। এটিও প্রায় একই সময় বাজারে আসার কথা রয়েছে। মধুমাসের আরেকটি খুব প্রিয় ফল আম। বাজার ঘুরে দেখা গেল, কয়েক জাতের আম বিক্রি করছেন দোকানিরা। প্রথম দিকে অতো মিষ্টি ছিল না। এখন বেশ স্বাদ। বর্তমানে বেশিরভাগ আম আসছে সাতক্ষীরা থেকে। ঢুকতে শুরু করেছে রাজশাহীর আমও। রাজশাহীতে গত ১৫ মে সব ধরনের গুঁটি আম গাছ থেকে নামানো শুরু হয়। এগুলোই কিছু কিছু ফলের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে। রাজশাহীর লক্ষণভোগ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে। আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুধবার থেকে জাত আম গোপালভোগ নামাবেন রাজশাহীর চাষীরা। ক্রমে নামানো হবে অন্যান্য জাতের আম। রানীপছন্দ ২৫ মে, হিমসাগর বা খিরসাপাত ২৮ মে, ল্যাংড়া ৬ জুন, আম্র্রপালি ১৫ জুন এবং ফজলি আম ১৫ জুন থেকে নামানো হবে। আর আগামী ১০ জুলাই থেকে নামতে শুরু করবে আশ্বিনা এবং বারী আম-৪। ঢাকায় কতটা আসবে তা নিয়ে সংশয় সন্দেহ আছে। এর মাঝে অবশ্য জাতীয় ফল কাঁঠাল পাওয়া যাচ্ছে। ছোট ও মাঝারি আকারের কাঠাল দেখা গেল কাওরান বাজারে। মোঃ শামীম নামের এক খুচড়া বিক্রেতা জানান, ঢাকার আশপাশ, যেমন, টাঙ্গাইল গাজীপুর মানিকগঞ্জ ইত্যাদি এলাকা থেকে যতটা সম্ভব কাঁঠাল আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি ভাল হলে জামালপুর শেরপুর ও ময়মনসিংহের কাঁঠাল আসার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি। গ্রীষ্মের গরমে খাওয়া চাই তরমুজও। এ সময় ফলটির আলাদা চাহিদা। রসালো ফল দেহের ভেতরের খরা কাটাতে খুব কাজে দেয়। এখন কম পরিমাণে হলেও, তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝারি সাইজের তরমুজই বেশি। একটি হাতে নিয়ে দাম জিজ্ঞেস করতেই বিক্রেতা বললেন, নিবেন? কেজি একদাম ৪০ টাকা। আনারসও অল্পস্বল্প পাওয়া যাচ্ছে। ছোট দেখতে আনারস আসছে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও বৃহত্তর সিলেটের শ্রীমঙ্গল থেকে। আকারে ছোট হলেও বেশ মিষ্টি রসালো। প্রতি পিস আনারসের খুচরা মূল্য ১৫ থেকে ২০ টাকা। বাঙ্গী ফলটা একদমই স্বাদের না। তাতে কী? এর উপকার অনেক। যারা জানেন, খুঁজে নিতে ভুল করেন না। পেট সাফ করতে ফলটির জুড়ি নেই। পদ্ধতি মেনে খেতে পারলে বেশি উপকার। দামও বেশি না। কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, প্রতি পিস ৩০ থেকে ৪০ টাকার বেশি হবে না। তালও মধুমাসের ফল। অন্যান্য বছর ধারাল দা দিয়ে কুপিয়ে তালের শাঁশ বের করতে দেখা যায় মৌসুমি বিক্রেতাদের। এবার তেমনি চোখে পড়ছে না। তবে সাতক্ষীরা, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল থেকে তালের শাঁশ আনার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানা গেছে। জামও একটু পরে আসে। এবার এখনও চোখে পড়েনি। জামরুল পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে একটার পর একটা ফল আসার কথা। তবে শেষতক কী হবে তা জানা নেই কারও। অন্যান্য সেক্টরের মতো ফলের বাজারও খেয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাস। এর হুমকির মুখে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। একই কারণে ফলের যোগান অন্য যে কোন বছরের তুলনায় অনেক কম। প্রসঙ্গ উঠতেই পাইকারি দোকানের এক অভিজ্ঞ কর্মচারী মহসিন বলেন, ‘গাছে ফল ধইরা পাকতাছে। নামাইতে পারতাছি না। আমরা টেকা দিয়া রাখছি বাগান মালিকের। কিন্তু ঢাকায় আনার সুবিধা করতে পারতেছি না। আর আনলেও বিক্রি করুম কার কাছে?’ সব মিলিয়ে এবার মধুমাসটা তাদের মধুর হবে না বলেই মনে করছেন তিনি। দুঃখ করে বললেন, মধুমাস এইবার তিতা হইয়া গেল।’ ক্রেতাদেরও মন খারাপ। কাওরান বাজার থেকে ফেরার পথে সাবেক সরকারী কর্মকর্তা সিরাজুল আলম বললেন, যে সময় যে ফল আসে তা খাওয়া শরীরের জন্য খুব ভাল। আমি শুধু ফল কেনার জন্যই করোনার মধ্যে রিস্ক নিয়ে কাওরান বাজারে এসেছিলাম। কিন্তু লিচু আম তেমন পাইনি। যা পেয়েছি, নিলাম। অভিজ্ঞতা এবার ভাল না হলেও তিনি বলেন, দেখা যাবে সামনে কী হয়।
×