ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী, কথায় কথায় ডিকশনারি

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ২০ এপ্রিল ২০২০

  অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী, কথায় কথায় ডিকশনারি

যে কোন সঙ্কটের সময়ই ডালপালা মেলবে গুজব, এটা সম্ভবত আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। যেমন- এবারের এই যে এক করোনা, এটা নিয়েওতো কত ভাবেই না বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। থানকুনী পাতা থেকে শুরু করে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ- বাদ যায়নি কোন কিছুই। ফেসবুকেই দেখেছি এদেশ থেকে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ নাকি রপ্তানী হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে! আমার নিজের চেম্বার এসিসটেন্ট-এর কাছে শুনেছি, তার বাসার আশেপাশে রাতের বেলা লোকজন টর্চলাইট জালিয়ে থানকুনি পাতার খোঁজ করছে। তারপরও এবার এই সব গুজব হালে পানি পাচ্ছে কিছুটা কম। মানুষ গুজবে যে একেবারে বিভ্রান্ত হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু এ ধরনের মানুষের সংখ্যা এবারে কম। আর পাশাপাশি বিশেষ কোন একটা গুজব খুব বেশি দিন স্থায়িত্বও পাচ্ছে না। মানুষ এবারে অন্যবারের চেয়ে একটু বেশি সচেতন। আমরাই তো চাঁদে সাঈদীকে দেখার গুজব শুনে মানুষকে রাস্তায় নেমে মরতে দেখেছি। বোরহানউদ্দীনে আর তারও আগে নাসিরনগরে দেখেছি গুজবে অন্ধ মানুষের উন্মত্ত আচরণ। সে তুলনায় এবারের পরিস্থিতিটা ঢের ভাল। এজন্য অবশ্য মূল ধারার মিডিয়া কর্মীদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। আর এই যে গুজব কালচার, এটা কিন্তু শুধু আমাদের সমস্যা না। কদিন আগেই দেখলাম, অস্ট্রেলিয়ার সরকার একটা নতুন এ্যাপস তৈরি করেছে যাতে সে দেশের মানুষ গুজবে বিভ্রান্ত না হন। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার ফেসবুকে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। মাঠে নেমেছেন আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীও। এ নিয়েও অবশ্য গুজব ছড়ানো হয়েছিল। আমরা কেউ-কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সরকার নজরদারিতে নিয়ে আসতে যাচ্ছে। এই গুজবটিও অবশ্য খুব একটা ভাত পায়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবৃতি এবং মূলধারার মিডিয়ার তৎপরতায় দ্রুতই তা মাঠে মারা গেছে। তবে গুজবে-গুজবে বেশ-কম আছে। কেউ-কেউ গুজব ছড়াচ্ছেন-খাচ্ছেন আতঙ্কের জায়গা থেকে। কেউ-কেউ গুজব ছড়াচ্ছেন এই সুযোগে টু-পাইস কামিয়ে নেয়ার ধান্ধায়। তবে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে গুজব ছড়ানো হচ্ছে মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি আর কিছু-কিছু ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অসৎ উদ্দেশ্য থেকে। এই ধারার অন্যতম গুজবটি হচ্ছে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী আর এ সংক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যাটি নিয়ে। শুনতে-শুনতে এখন কেউ-কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করছেন করোনায় এদেশে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। রোগীও আছে অনেক বেশি। সরকার ইচ্ছে করে তা চেপে রাখছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এদেশের মুখচেনা কিছু বুদ্ধিজীবী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন ভাল কথা, দিচ্ছেন বক্তৃতা-বিবৃতিও। আর এক শ্রেণীর মূলধারার মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচারও করা হচ্ছে। লক্ষণীয় তাদের এসব বক্তব্যের সমর্থনে এসব বিশিষ্ট ব্যক্তি কোন তথ্য প্রমাণ কিন্তু উপস্থাপন করছেন না। কেউ-কেউ পাটীগণিতের সাহায্য নিচ্ছেন নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে। এমনি যারা বলতে চান যে, করোনায় মৃতের সংখ্যাটা অনেক বেশি, তাদের জন্য একটা সহজ পাটীগণিত। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের একদল গবেষক সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষ বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার-এ পর পর দুটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। সেই প্রকাশনাগুলো থেকে আমরা জানতে পারছি যে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত যেসব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আইসিইউ সাপোর্ট নিতে হয়, তাদের গড়ে দশ দিনের মতো হাসপাতালে থাকতে হয়। অর্থাৎ, দশ দিনে তারা হয় ভাল হয়ে বাসায় ফিরে যাবেন, অথবা তাদের মধ্যে কেউ কেউ আর ফিরবেন না। সেই হিসেবে কোন দেশে করোনা আক্রান্ত প্রথম যে রোগীটি মৃত্যুবরণ করবেন, গড়ে তার দিন দশেক আগে সে দেশে প্রথম সিম্পটোমেটিক কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা। বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছিল ১৮ মার্চ। আর প্রথম সিম্পটোমেটিক কোভিড-১৯ রোগীরা শনাক্ত হয়েছিলেন ৮ মার্চ। হিসেবটা বোধকরি খুব জটিল না। করোনার কারণে আমরা ইদানীং অনেক নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এপি সেন্টার। শব্দটি আসলে ব্যবহার করা হতো পারমাণবিক বোমা যেখানে বিস্ফোরিত হয় সেই জায়গাটাকে বোঝানোর জন্য। বোমা বিস্ফোরণে ক্ষতির মাত্রাটা সবচেয়ে বেশি হয় ঐ জায়গাটিতেই। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মানবজাতি তেমনটিই দেখেছে। এবারের করোনা দুর্যোগের প্রথম এপিসেন্টারটি ছিল চীনে আর এখন তা ইউরোপে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনার পরের এপিসেন্টারটা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত উষ্ণপ্রধান কোন অঞ্চলে করোনার এপিসেন্টার দেখা যায়নি। ইন-ভিট্রো বা শরীরের বাইরের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে এবারের নোবেল করোনাভাইরাসটি ৭০০ সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। আবার আমরা এও জানি যে, এটি একটি ক্যাপসুলেটেড ভাইরাস। অর্থাৎ, এর একটি চর্বির আবরণ রয়েছে। যে কারণে এটির খূব বেশি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারার কথা না। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত এবারের এই করোনাভাইরাসটি সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে উঠতে পারেননি। এ জন্য প্রয়োজন আরও গবেষণা ও সময়ের। কাজেই উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে এর বিহেভিয়ার ঠিক কেমন হবে, তা এখনও বলা কঠিন। তবে এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখছি তা হলো, করোনায় বিশ্বব্যাপী যে মৃত্যুর মিছিল, তাতে শতকরা ৯৫ জনই মারা গেছেন শীতপ্রধান অঞ্চলে। বাংলাদেশ তো পৃথিবীতে কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয় যে, কোন কথা নেই, বার্তা নেই এখানে সহসা শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষ মৃত্যুবরণ করবেন। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারত কিংবা পাকিস্তানেও আমরা এখন পর্যন্ত শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেখিনি। আজকের এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে শয়ে-শয়ে কেন, একটি-দুটিই অস্বাভাবিক মৃত্যুই তো লুকিয়ে রাখা দুষ্কর। আর সেই দেশে তো তা একেবারেই অসম্ভব যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি। আর সঙ্গে আছে চল্লিশটিরও বেশি ইলেকট্রনিক ও কয়েকশ প্রিন্ট মিডিয়া। আর সবচেয়ে বড় কথা, আছে আরও প্রায় পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। যারা বলে চলেছেন যে, এ দেশে শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষ করোনায় মৃত্যুবরণ করছেন, তারা নিজেরাও একথা বিশ্বাস করেন না। কারণ তাদের নিজেদের আচরণে আমি এর কোন ধরনের প্রতিফলন দেখি না। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা করোনা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত ছুটিকে ঈদের ছুটি বানিয়ে ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই সেদিন জড়ো হয়েছিলেন শাহবাগে সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হাসপাতাল থেকে বাসায় পৌঁছে দিতে এবং এখনও তাদেরই কেউ-কেউ অত্যন্ত বিরস বদনে মোড়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে-ফাঁকে আমার এই লেখাটায় চোখ বোলাচ্ছেন। এখন সময়টা দায়িত্বশীলতার। দায়িত্বহীনতার কিংবা ফেসবুকে যেনতেন আরেকটা স্ট্যাটাস দিয়ে কয়েকশ লাইক জমানোর না। আমাদের কারও কোন সামান্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় পরিস্থিতি যদি এতটুকুও অস্থিতিশীল হয়, তার ধাক্কাটা কিন্তু সবার আগে এসে পড়বে আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর ওপরই। কারণ, করোনাভাইরাস কোন দল চেনে না, আর এর কোন রাজনৈতিক দর্শনও নেই। আর যারা এসব দায়িত্বহীন বক্তৃতা-বিবৃতিতে ভয় পাচ্ছেন, তাদের মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাম্প্রতিক একটি লেখা থেকে ধার করে একটা পুরনো বাগধারা মনে করিয়ে দিতে চাই, ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী, কথায় কথায় ডিকশনারি’। লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×