ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৮৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব বিএনপির

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ৫ এপ্রিল ২০২০

 ৮৭ হাজার কোটি টাকা  বরাদ্দের প্রস্তাব  বিএনপির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তায় ৮৭ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। শনিবার বেলা ১১টায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের পক্ষ থেকে এটিসহ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ২৭ দফা প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবগুলো বিএনপি সরকারের কাছে প্রেরণ করা হবে বলেও তিনি জানান। ফখরুল বলেন, ৮৭ হাজার কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দে স্বল্পমেয়াদী খাতে ৬১ হাজার কোটি টাকা, মধ্যমেয়াদী খাতে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত আরও ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিচ্ছি। এছাড়া করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে জাতীয় ও বৈশ্বিক মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাতে করোনাভাইরাস না ছড়ায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া তিনি গৃহহীন দুস্থ জনগোষ্ঠীর মুখে খাবার তুলে দিতে দেশের জনহিতৈষী ও বিত্তবানদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। আর অবিলম্বে দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি আপাদকালীন অর্থনৈতিক টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব করছি। সারাদেশে ব্যাপকহারে করোনা পরীক্ষা না করার সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এটা কি উদাসীনতা না উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা বোধগম্য নয়। এজন্য জাতিকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এখন বেশি প্রয়োজন পরীক্ষার কিট এবং চিকিৎসক-নার্সদের জন্য পিপিই সরবরাহ নিশ্চিত করা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরীক্ষা কিট, সম্পূর্ণ পৃথক কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন কেন্দ্র স্থাপন, পর্যাপ্ত আইসিইউ স্থাপন ও ভেন্টিলেটর সরবরাহ এবং নিরাপদ দূরত্বে সম্পূর্ণ পৃথক হাসপাতাল স্থাপন করা। মির্জা ফখরুল বলেন, এই মুহূর্তে ডেঙ্গু দরজায় কড়া নাড়ছে। ইতোমধ্যে গত বছরের তুলনায় বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। শাটডাউনের কারণে এডিস মশা নিধন কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ে দলের বক্তব্য তুলে ধরেছি। এখন আমরা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের জন্য প্রস্তাব রাখছি। আমাদের প্রদত্ত প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের জন্য জিডিপির ৩ শতাংশ অর্থ সমন্বয়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল ঘোষণা করতে হবে। শাটডাউন প্রত্যাহার হলে নতুন করে একটি সংশোধিত আর্থিক প্যাকেজ প্রদান করতে হবে যেন, সকল সেক্টারের অর্থনৈতিক কর্মকা- সাধারণ ছুটিপূর্ব স্তরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। ফখরুল বলেন, জাতীয় ও বৈশ্বিক মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় যে কোন গঠনমূলক ও কল্যাণমুখী উদ্যোগে সামিল হতে বিএনপি প্রস্তুত। এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দম্ব, অহংকার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহার করে সরকারকেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমিন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মহান আল্লার অশেষ রহমতে আমরা এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ। ফখরুল বলেন, গত সাপ্তাহে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে টেলিকরফারেন্সের মাধ্যমে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ২৭ দফা প্যাকেজ প্রস্তাব তৈরি করে। এ অনুসারে স্বল্পমেয়াদী প্রস্তাবের মধ্যে দিন এনে দিন খায় ক্যাটাগরির সকল শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সাওয়ালা, ভ্যানচালক, হকার, ভাসমান শ্রমিক, ছিন্নমূল, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সিএনজি ড্রাইভার, ভাড়াভিত্তক গাড়ি চালক (উবার, পাঠাও) পরিবহন শ্রমিক, বস্তিবাসী মহামারীর কারণে কর্মহীন হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে চাল-ডাল-লবণ-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবস্থা এবং এপ্রিল, মে ও জুন এ ৩ মাসের জন্য জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা নগদ অর্থ বরাদ্দ, আশ্রয়হীনদের অস্থায়ী আবাসন ও প্রয়োজনে তাদের জন্য তৈরি খাবার সরবরাহে ন্যূনতম ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা। গার্মেন্টস ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সেবার জন্য অর্থ ও জীবন যাত্রায় সমর্থন প্রদান ও তাদের নগদ অর্থ সাহায্য প্রদান করা। ৬ মাসের জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক, রফতানিমুখী গার্মেন্টস শ্রমিক, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় পরিচালিত অন্যান্য শিল্প কারখানার শ্রমিকদের জন্য আলাদাভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা, কৃষকদের উন্নয়ন ও বীজসহ কৃষি উপকরণ সরবরাহ ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা। এক বছরের জন্য পোল্ট্রিসহ সকল ধরনের কৃষিঋণের কিস্তি ও সুদ মওকুফ, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সকল ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ, প্রবাসী শ্রমিক যারা দেশে ফিরেছে তাদের জন্য তিন মাসের জন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকার আপদকালীন সাপোর্ট প্রদানের জন্য এই খাতে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা। স্বাস্থ্য খাত এবং করোনা মোকাবেলায় সঙ্গে যুক্ত হাসপাতাল ও সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যুক্ত প্রতি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু, চিকিৎসকদের জন্য এক কোটি, নার্সদের জন্য ৭৫ লাখ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমা বিপরীতে প্রিমিয়াম সরকারকে বহন করা। বয়স্ক নারী, বিধবা, প্রতিবন্ধী, ষাটোর্ধ বয়স্কদের আগামী তিন মাস ৫ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ প্রদানে এ খাতে ২ হাজার কোটি টাকা বরদ্দ করা। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে যারা গ্রামে চলে গেছেন তাদের সহযোগিতার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা আপদকালীন ভাতা প্রদান এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারগুলোকে আগামী তিন মাসের জন্য রান্নার গ্যাস ও গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার সরবরাহের সুপারিশ প্রস্তাব করছি। মির্জা ফখরুল বলেন, মধ্যমেয়াদী প্রস্তাবনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কতিপয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সুদ মওকুফ ও ঋণের নিয়মিত কিস্তি তিন মাসের জন্য স্থগিতকরণ, সব ব্যাংককে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা প্রদান, তারল্য বৃদ্ধি করে ফিনান্সিয়াল মার্কেটের আস্থা বাড়াতে সম্প্রসারণশীল মনিটরিং পলিসি গ্রহণ, বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ ন্যূনতম ১৫ থেকে ১৬ ভাগ উন্নতিকরণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেইট, সিআর, এসএলআর, রিপোর হার কমানো, ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ড ক্রয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য এবং বিশেষ করে দেশীয় পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য রি-ফাইন্যান্স করা। এসএমইর অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত করতে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট রিলিফ প্যাকেজ প্রদান, সরকারের ব্যয় সংকোচন, অপচয় রোধ করে সেই অর্থ দিয়ে রফতানিমুখী শিল্প, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিল্পকে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, করনীতির আওতায় কর্পোরেট করের হার হ্রাস, আপদকালীন সময়ের জন্য কর মওকুফ, ব্যক্তিগত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এডভান্স ইনকামট্যাক্স আদায় বন্ধ রাখা, অপ্রয়োজনীয়, অনুৎপাদনশীল ও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেয়া, অপচয় রোধ, কঠোর কৃচ্ছ্র সাধন করা। মেগা প্রকল্পগুলোর অর্থ ব্যয় কিছুটা মন্থর করা, অসাধু ব্যবসায়ী ও দালাল শ্রেণীর লোকদের ওপর নজরদারি রেখে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, উৎপাদন ও সরবারহ চেইন নির্বিঘœ রাখা, অবিলম্বে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও আইএমএফসহ দ্বিপাক্ষিক আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থ সংগ্রহ করা, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচুয়েটি জমা দুর্যোগকালীন পর্যন্ত স্থগিত রাখা, প্রবাসী শ্রমিকরা যাতে এই সময়ে ছাঁটাই না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকা- স্থবির হওয়ায় তা সচল করতে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা। কৃষি খাতে সহায়তা প্রদানে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ, খাদ্য প্রবাহ যেন বন্ধ না হয় সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করছি। গণমাধ্যমের জন্য আর্থিক প্যাকেজ প্রদানের প্রস্তাব করে মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, তথ্য প্রবাহ ও জনমতামত তুলে ধরে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকি মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা অনেক সময় ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। করোনাভাইরাস মহামারীতে সংবাদ কর্মীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যে আর্থিক প্যাকেজ পেশ করা হয়েছে তার অধিকাংশই যুক্তিসঙ্গত। দেশের এই ক্রান্তিকালে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সাংবাদিকদের আর্থিক ও অন্য দাবিগুলো সুবিবেচনা করতে হবে।
×