ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর

করোনা মোকাবেলায় ঘরে মানুষ ॥ বিচ্ছিন্ন দেশ

প্রকাশিত: ১০:০৯, ২৮ মার্চ ২০২০

  করোনা মোকাবেলায় ঘরে মানুষ ॥ বিচ্ছিন্ন দেশ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ঘরে ফিরেছে মানুষ। স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী সবাই। বিচ্ছিন্ন দেশ। চলছে অঘোষিত লকডাউন। ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে। করোনা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত ১০ দিনের ছুটি ঘোষণার দ্বিতীয় দিন ছিল শুক্রবার। ছুটির দিনে রাজধানীজুড়ে নেমে আসে রাজ্যের নীরবতা। পিনপতন আওয়াজ নেই দূষণ আর যানজটের এই নগরীতে। প্রাণঘাতী করোনার জীবাণু ধ্বংস করতে পুলিশ ও সেনা সদস্যদের বিভিন্ন যানবাহনে স্প্রে করতে দেখা গেছে নগরীর রাস্তায়। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ছিটানো হচ্ছে জীবাণুনাশক পানি। এদিকে রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিপেটার শিকার হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, দেশে কোন লকডাউন, কারফিউ বা জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়নি। তবে কেন? প্রয়োজনে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। একই অভিযোগ করেছেন অটোরিক্সা ও রিক্সা চালকরা। কোন আইনে সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশ লাঠিপেটা করছে এর বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। অকারণে রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষকে হয়রানি না করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। শুক্রবার দুপুরে তার সরকারী বাসভবন থেকে ফেসবুক লাইভ ও বিটিভির মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবদানকালে তথ্যমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বৃহস্পতিবার থেকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ অকারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে তথ্যমন্ত্রী দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যমন্ত্রী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষকে অকারণে হয়রানি না করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাধারণ মানুষ ব্যাপক সাড়া দিয়েছে জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, সাধারণ মানুষ বাইরে বেরোচ্ছেন না। শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এক ভুতুড়ে পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। খাবার হোটেল পর্যন্ত খোলা নেই। সীমিত পর্যায়ে কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকানসহ নিত্যপণ্য বাদে সবকিছু লকডাউন। রাস্তায় কিছু রিক্সা ছাড়া একেবারেই কোন যানবাহন নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি অটোরিক্সা ও প্রাইভেটকার এলে সবগুলো পুলিশের নিরাপত্তা চৌকিতে আটকানো হয়। তাদের ঘর থেকে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়। জবাব সন্তোষজনক না হলে গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা ও ফের গাড়ি ফিরিয়ে দেয়া হয়। রিক্সা ও অটোরিক্সা চালকরাও পুলিশের নানামুখী হয়রানির শিকার হয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, গাড়ি বের করার কারণে কাউকে ধমক, কাউকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছে। মানুষকে ঘরমুখো করতে পাড়া-মহল্লায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। আবার পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করার চিত্রও দেখা গেছে। মাইকে সবাইকে ঘরে নিরাপদ স্থানে থাকতে বলা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে পুলিশের পক্ষ থেকে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাঠ প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে বৃহস্পতিবার থেকে ৬১ জেলায় সেনাবাহিনী মাঠে নেমেছে। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সেনা টহল লক্ষ করা গেছে। সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ গাড়িতে ঝোলানো হয়েছে জনসচেতনতামূলক ব্যানার। সেখানে লেখা ছিল, ‘ অপ্রয়োজনে কেউ নিজ ঘরের বাইরে যাবেন না’। ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন, নিজ নিজ বাসস্থানে অবস্থান করুন’। ‘হাত দিয়ে নাক মুখ চোখ স্পর্শ থেকে বিরত থাকুন’। এছাড়া কিছু ট্রাকে জীবাণুমুক্তকরণ কর্মসূচীর ব্যানার টানানো ছিল। ট্রাকের পেছনে দেখা গেছে নগরীর রাস্তায় জীবাণু-মুক্তকরণের জন্য পানি ছিটাতে। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন বাজারসহ মোড়ে মোড়ে সেনাবাহিনীর টহল টিম নেমে হ্যান্ড মাইকে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। তারা বলেন, অকারণে কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। অযথা ঘোরাঘুরি করে নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন না। আপনি ঝুঁকির মধ্যে পড়লে আপনার পরিবারের সদস্যরাও নিরাপদ থাকবে না। তারাও আক্রান্ত হতে পারেন। তাই কাজ না থাকলে ঘরে ফিরে যান। কাজ থাকলে দ্রুত শেষ করে বাসায় ফিরুন। বাসা থেকে বিশেষ প্রয়োজনে বের হলে মুখে মাস্কসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করুন। বাংলাদেশে নতুন করে আরও চারজনের মধ্যে নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে; যাদের মধ্যে দুজন চিকিৎসক রয়েছেন। আর এই চারজনের মধ্যে একজনকে শনাক্ত করা হয়েছে আক্রান্তদের একটি ‘ক্লাস্টার’ থেকে; তবে সেখানে প্রথম সংক্রমণ কোথা থেকে এসেছিল তা নিশ্চিত হতে পারেনি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআর। ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা শুক্রবার এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে নোভেল করোনাভাইরাস মহামারীর সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নতুন আক্রান্ত চারজনকে নিয়ে দেশে নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৪৮ জনে। গত ৪৮ ঘণ্টায় নতুন করে কারও মৃত্যুর তথ্য না আসায় মৃতের মোট সংখ্যা আগের মতোই পাঁচজনে রয়েছে। এদিকে গুলশান পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ওষুধের দোকানে করোনাভাইরাস ঠেকাতে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওষুধ সরবরাহের জন্য গোলবৃত্ত করে দেয়া হয়েছে। পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী জানান, গুলশান থানা কর্তৃক গুলশান-২ পয়েন্ট এলাকার ফার্মেসিগুলোর সামনের ফুটপাথে বাধ্যতামূলক সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ করা হচ্ছে। দোকানে ক্রেতাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ওষুধ কিনতে দেখা গেছে। ইসলাম ফার্মা ও আলামিন ফার্মেসির সামনে পুলিশ লাল রং দিয়ে গোলবৃত্ত করে দিতে দেখা গেছে। আবার বিভিন্ন বাসা বাড়িতে মালিকরা করোনারোধে কঠোর কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসা ও কমিউনিটি সেন্টারের সামনে কাগজে লেখা রয়েছে, আপনি এই ভবনের বাসিন্দা না হলে দয়া করে ভেতরে আসবেন না। হঠাৎ এরকম সচেতনতা দেখে অনেকের চোখ যেন কপালে। রাজধানীর সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বাইরে খাবার হোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় অনেকটাই অসহায় তারা। আবার বিভিন্ন বাসা বাড়িতে মেসে থাকা ছাত্ররাও বিপাকে পড়েছেন। কোথায় কাজের লোক ছুটিতে, কোথাও আছে বাড়ির মালিকের না আসার নিষেধাজ্ঞা। সব মিলিয়ে খাওয়া নিয়ে মহাসঙ্কট দেখা দিয়েছে। করোনার উৎপত্তিস্থল চীন থেকে বাংলাদেশে সম্প্রতি আসা এক ব্যক্তি জানান, চীনে লকডাউন করার পর প্রতিটি বাসা বাড়িতে খাবারের সঙ্কট দেখা দেয়। তখন বাইরের বেশকিছু রেস্টুরেন্ট জনস্বার্থে খোলা রাখার ব্যবস্থা ছিল। অনলাইনে খাবার আনা যেত। মোবাইলে খাবার অর্ডার দেয়া হতো, বিল দেয়া হতো মোবাইল থেকেই। কিছু সময় পর খাবারের কোড নম্বর ও রেখে যাওয়ার স্থান এবং সময় মেসেজ করে জানিয়ে দেয়া হতো। বাসার আশপাশে রেখে যাওয়া নিরাপদ স্থান থেকে স্থানীয় লোকজন কোড নম্বর মিলিয়ে খাবার সংগ্রহ করতেন। কিন্তু যানবাহন বন্ধ ও সাধারণ ছুটির ঘোষণা শেষে সবাইকে ঘরে থাকতে সরকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ক্রেতা সঙ্কটের আশঙ্কায় বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর সব রকমের রেস্টুরেন্ট। ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিশ রিলেশন্স বিভাগ) মাসুদুর রহমান হোটেল থেকে পার্সেলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ক্রেতা সশরীরে হোটেলে এসে খাবার নিয়ে যেতে পারবে। হোটেল থেকে বাসায় বাসায় খাবার পৌঁছে দেয়ার সুযোগ থাকছে না । কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্সেল হিসেবে খাবার বিক্রির সুযোগ থাকার বিষয়টি জানেন না অনেক মালিক। এ কারণে তারা হোটেল খুলছেন না বলে দাবি করেছেন। তাছাড়া দশ দিন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা পেয়ে অধিকাংশ কর্মচারী ঢাকা ছেড়েছে। জনবল সঙ্কটের কারণে ক্রেতাদের সেবা দিতে পারছেন না অনেক হোটেল কর্তৃপক্ষ। এদিকে ডিএমপির পক্ষ থেকে খোলা রাখার সিদ্ধান্ত থাকলেও রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার হোটেল বন্ধ দেখা গেছে। শুক্রবার রাজধানীর কমলাপুর, মতিঝিল, আরামবাগ, মালিবাগ, রামপুরা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, গুলশান, নতুন বাজার, খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট, বনানী, মহাখালী, আমতলী, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, আদাবর, ধানম-ি, কলাবাগান, রাইফেল স্কয়ার, শাহবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে নীরব সব সড়ক। রাস্তায় মানুষ নেই। সবাই ঘরে আছেন নিরাপদে। বৃহস্পতিবার থেকে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কার্যকরের মধ্য দিয়ে সামান্য চায়ের স্টল পর্যন্ত খোলা দেখা যায়নি। তেমনি সড়ক-মহাসড়ক ফাঁকা। যানবাহন নেই। নেই কোলাহল। যানজট নেই। শুধুমাত্র হাতেগোনা কিছু পণ্যবাহী পরিবহন জরুরী সেবায় নিয়োজিত। রাস্তায় পাওয়া গেছে কিছু এম্বুলেন্স, সংবাদপত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি।
×