ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টম আর জেরির দ্বৈরথ

প্রকাশিত: ১২:১৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

টম আর জেরির দ্বৈরথ

২০১৬ সাল। মিসরে তখন দেশজুড়ে চলছে অস্থিরতা, সহিংসতা। এরই মধ্যে দেশটির এক সরকারী কর্মকর্তা দাবি করে বসলেন এই অরাজকতার পেছনে দায়ী হলো টম বিড়াল এবং জেরি নামের নেংটি ইঁদুর। সারাদিন এই দুইটার মারামারি দেখে শিশু কিশোররা সংঘাত করা শিখেছে। আড়ালে নয় রীতিমতো সাংবাদিকদের সামনে ডেকে এমন মন্তব্য করে বসলেন আবদেল সাদেক নামের ওই তথ্য অফিসার। তবে আবদেল সাদেক কিন্তু একমাত্র লোক নয় যিনি ভাবেন টম আর জেরির কাজ শুধুই ‘গ্যাঞ্জাম’ করা। এক সময় ঠিক একই ভাবনা এসেছিল টম এ্যান্ড জেরির নির্মাতা মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার এবং নির্মাণে সংশ্লিষ্ট সবার! একটামাত্র ধারণা বা কনসেপ্ট থেকে কি কি করা যায়? একটা বিড়াল যার একমাত্র কাজ জেরি নামের একটা ইঁদুরকে ধাওয়া করে বেড়ানো। সারমর্ম কিন্তু এতটুকই। নির্মাতারা ভেবেছিলেন একসময় হয়ত একঘেয়ে হয়ে যাবে কার্টুনটি। বিরক্ত হবে দর্শক। কিন্তু জন্ম নিল এক ইতিহাসের। ছেলেবুড়ো সবার মুখেই হাসি ফোটাচ্ছে টম এ্যান্ড জেরি। হাসলে স্বাস্থ্য-মন ভাল থাকে। আর হাসার জন্য নাকি মনস্তত্ত্ববিদরাও অনেক সময় দেখতে বলেন টম এ্যান্ড জেরি। এবার তাহলে কার্টুনটির পেছনের কিছু গল্প জেনে নেয়া যাক। সময়টা ১৯৩০ সাল। হলিউড তখন গড়ে উঠছে। প্রতিদিন নব্য সব প্রযুক্তি আর বিনোদনের উপাদান যোগ হচ্ছে। হলিউডের মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার স্টুডিওর সময় ভাল যাচ্ছে না। তাদের নির্মাণ করা কোন কার্টুনই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোর কাছে ব্যবসা হারাচ্ছে এমজিএম। জলের মতো টাকা খোয়াচ্ছে এমজিএম। অভিজ্ঞ পরিচালক জোসেফ বারবারা এবং গল্প লেখক ও চরিত্র ডিজাইনার উইলিয়াম হ্যানা একটি বিড়াল এবং ইঁদুরকে কেন্দ্র করে একটি কার্টুন বানাতে চাইলেন যার নাম ছিল ‘পুস গেটস দ্য বুট’। জ্যাসপার নামের ধূসর একটি বিড়াল এবং জিনক্স নামের একটি ইঁদুরকে ধাওয়া করার সময় জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছে আর ইঁদুরটি বিড়ালকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। ১৯৪০ সালে কার্টুনটি প্রথম থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়। পুস গেটস দ্য বুট’। কোন সূচনা মিউজিক ছাড়াই মুক্তি পায়। এরই মধ্যে এমজিএম-এ কান পাতলে ভেসে উঠে নানা কথা। ‘ইঁদুর বিড়াল নিয়ে কি কম হলো! এবার থামো’। হয়ত জন্মই হতো না টম এবং জেরির। কিন্তু ১৯৪১ সালে যখন এ্যাকাডেমি এ্যাওয়ার্ডের জন্য ‘পুস গেটস দ্য বুট’ মনোনয়ন পায় তখন হৈচৈ শুরু“হয়ে যায়। পুরস্কার না পেলেও এমজিএম নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়। এরই মধ্যে একদিন জরুরী তলব আসে হ্যানা বারবারার। প্রযোজক ফ্রেড কুইম্বলি তাকে ডেকে পাঠালেন। অন্যসব কাজ বাদ দিয়ে এই কার্টুনটির সিরিজ বানাতে বলেন। নির্মাতারা নাম বদলের সিদ্ধান্ত নিলেন। দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ানো ইঁদুর-বিড়ালের নামকরণের জন্য এমজিএমের ভেতরেই এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। এ্যানিমেটর জন কারের প্রস্তাব করা ‘টম এ্যান্ড জেরি’ নামটি মনে ধরে যায় সবার। তাঁকে স্মারক হিসেবে ৫০ ডলার পুরস্কারও দেয়া হয়। নির্মাতাদের ভয় ছিল যে সারাক্ষণ টম সারাদিন জেরিকে তাড়া করে বেড়াবে- এতে করে একঘেয়েমি চলে আসতে পারে। কিন্তু গল্প লেখক বারবারা দুর্দান্ত কিছু ভিন্নতা এনে টম এ্যান্ড জেরিকে দেন অমরত্বের স্বাদ। ১৯৪৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম টিভিতে দেখানো হয় টম এ্যান্ড জেরিকে। তবে একটা সময় ইঁদুর-বিড়ালের যুদ্ধ নিয়ে এমজিএমের আগ্রহও কমে গিয়েছিল। ১৯৪১ সাল থেকে পরের ১৭ বছরে টম এ্যান্ড জেরি এবং পুস গেটস দ্য বুট’। মিলে ১০০-এর বেশি তৈরি হয়। পরের বছর থেকে কমিক বইয়র আসে কার্টুনটি। ১৯৫৮ সালের পর কিছু সময় বন্ধ ছিল টম এ্যান্ড জেরির নির্মাণ। ১৯৬১ সালে নতুন করে যাত্রা শুরু করে টম এ্যান্ড জেরি। ততদিনে এ্যানিমেশনের উন্নতি হয়েছে বেশ। এবার আরও মসৃণ এবং চকমকে হয়ে ওঠে টম এবং জেরি। ১৯৬৩ সালে চাক জোনস দায়িত্ব পান টম এ্যান্ড জেরির। ততদিনে টম এ্যান্ড জেরির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। তবে নতুন করে জোনসের নির্মাণ করা পর্বগুলো আগের পর্বের তুলনায় খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। ১৯৯০ সালে আবার পুরনো কারিগরের হাত পায় টম এ্যান্ড জেরি। হ্যানা বারবারা টম এ্যান্ড জেরি কিডস নিয়ে আবার হাজির হন। পরের বছর প্রথম ‘দ্য মুভি’ নামে বড় পর্দায় আসে টম এ্যান্ড জেরি। বর্তমানে ওয়ারনার ব্রোস স্টুডিও টম এ্যান্ড জেরির তত্ত্বাবধানে আছে। সাফল্যের পথ কিন্তু একেবারে মসৃণ হয় না। বিতর্ক ছিল এই কার্টুন জুটি নিয়েও। প্রথমদিকে এমজিএম স্টুডিওর মধ্যে অনেকেই টম এ্যান্ড জেরির মারামারিকে উগ্রতা হিসেবেই দেখত অনেকে। একে অন্যকে শায়েস্তা করতে যে সব অদ্ভুত পন্থা ব্যবহার করত, এ্যানিমেশন জগতে তখন সেটা ভায়োলেন্স হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু স্টুডিও আবিষ্কার করে টম-জেরির মারামারি বা পটকাবাজি বা বোমাবাজি নিয়ে দর্শকদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। হাসি-ঠাট্টায় ওসবকে দর্শকরা উগ্রতা বলে মনে করছে না। আর যাই হোক কেউই উগ্রতা শিখছে না। শুধু যে কার্টুনেই হাসির খোরক হয়েছে টম আং জেরি সেটা কিন্তু নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে টম এ্যান্ড জেরিকে নিয়ে হয়েছে হাজার হাজার মিম বা ট্রল। একদিকে যখন ইতিহাসের সব থেকে বেশি আয় করেও কোন সিনেমার জন্য অস্কার অধরাই থেকেই যায় আরেকদিকে একটা কার্টুন হয়েও টম জেরির ঝুলিতে আছে ৭টা অস্কার সঙ্গে আরও ৬ বার মনোনয়ন পাবার রেকর্ড। অনেক নির্মাতা হিংসা করতেই পারেন এই কার্টুন জুটিকে নিয়ে। ছোটবেলায় সবারই সম্ভবত মনে হতো জেরি বড্ড ফাজিল, টম এই ফাজিলটাকে ধরে ফেলুক এবং শায়েস্তা করুক। তবে টম সেটা করতে পারেনি, কখনও না-ই করতে পারুক, বেঁচে থাক টম আর জেরির দ্বৈরথ। বেঁচে থাক ছেলে-বুড়ো সবার মুখে হাসি। ধন্যবাদ টম এবং জেরি। আমাদের মুখের হাসি চওড়া থেকে আরও চওড়া করার জন্য।
×