ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সড়ক নিরাপদ করতে পরিকল্পনা ও বড় বিনিয়োগ দুই-ই দরকার

প্রকাশিত: ১০:২১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  সড়ক নিরাপদ করতে পরিকল্পনা ও বড় বিনিয়োগ দুই-ই দরকার

ওয়াজেদ হীরা ॥ অনিরাপদ সড়কে থামে না মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই সড়কের দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সড়ক নিরাপদ করতে নানা উদ্যোগ নিয়ে কাজও করে যাচ্ছে সরকার। করা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। তবুও যেন সড়ক নিরাপদ হচ্ছে না! নিরাপদ সড়কের জন্য আইনের কঠোর বাস্তবায়নের পাশাপাশি আগামী দশকে বড় বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা দুই-ই দরকার মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার কেউ কেউ মনে করছেন সঠিক পথেই সড়কের উন্নয়ন পরিকল্পনা এগিয়ে যাচ্ছে। দরকার কাজের গতি বাড়ানো আর তদারকি। জানা গেছে, নিরাপদ সড়কের জন্য বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে সরকারের। তবুও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। দেশের অনেক জায়গায় এখন নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা গেছে। অনেক জায়গায় ফোরলেন রাস্তা চলার পথকে করেছে আরামদায়ক ও সহজ। ফোরলেন থেকে ছয়লেন এমনটি দশলেন রাস্তা করার চিন্তাও করছে সরকার। রাজধানী নিয়েও সরকারের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে মেট্রোরেল প্রকল্প কার্যক্রম চলছে দ্রুত গতিতে। তবুও মানুষের মধ্যে অসচেতনতা, আইনের প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা আরও নানা কারণে এখনও অনিরাপদ রয়ে গেছে সড়ক। এদিকে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে বলে পরিসংখ্যান দিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। যারা দীর্ঘদিন নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করছেন। আর এক সেমিনারের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ঢাকায় যানজটের কারণে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টার অপচয় ও আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। সড়কে এত দুর্ঘটনা আর সময় বাঁচানোর পরিকল্পনা যেমন দরকার তার পাশাপাশি বিনিয়োগের কথা বলছেন বিশিষ্টজনরা। নিরাপদ সড়কের জন্য বিনিয়োগ আর পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে পরিকল্পনা সচিব মোঃ নুরুল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী একনেক সভাতে সবসময়ই বলেন মাস্টারপ্ল্যান করতে হবে সারাদেশে। এক এলাকায় উন্নয়ন হবে অন্য এলাকায় হবে না সেটি যেন না হয়। জেলার যে সংযোগসড়কগুলো আছে তা ধীরে ধীরে ফোরলেনে উন্নীতকরণ। তাহলে সবগুলো পরিকল্পিত, কোন অপরিকল্পিত কাজ নেই। যেহেতু মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় করতে হবে, একটার সঙ্গে একটার লিঙ্ক থাকতে হবে। এখানে কোন কাজই অপকল্পিতভাবে হওয়ার সুযোগ নেই। সম্প্রতি, স্টকহোমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে তৃতীয় গ্লোবাল মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সড়ক নিরাপদ করতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিমাণ হ্রাস ও সড়ক ব্যবস্থা নিরাপদ করতে আগামী দশকে বাংলাদেশকে ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৬৬ হাজার তিন শ’ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ শ্যাফার বলেছেন, বিগত বছরগুলোতে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় যানবাহনের সংখ্যা ব্যাপক বাড়িয়েছে। ফলে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ার সড়ক নিরাপত্তা সঙ্কট অগ্রহণযোগ্য, কারণ এটা প্রতিরোধযোগ্য। তবে সুখবর হলো- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের জনগণকে রক্ষার, জীবন বাঁচানো ও বৃহত্তর সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রাকে টেকসই করার জরুরী প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পেরেছে। এ প্রচেষ্টায় সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক সব সময় প্রস্তুত। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তিনি সড়ক নিরাপত্তা আইন মানার আহ্বান জানান। বিশ^ব্যাংকের পাশাপাশি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। এরমধ্যে সড়কও আছে। আগামী এক দশকে নিরাপদ সড়কের জন্য যে অর্থ বাংলাদেশের প্রয়োজন বলে বিশ্বব্যাংক প্রাক্কলন করেছে সেখানে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে। বিশ্বব্যাংক থেকে নিরাপদ সড়ক নিয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোন প্রস্তাব পায়নি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বিশ্বব্যাংক উইং। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বিশ্বব্যাংক উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ শাহাবুদ্দিন পাটোয়ারি জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে কি করতে চায় কি ভাবনা তা প্রজেক্ট দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা, কিভাবে কোন দিক দিয়ে ইনভেস্ট করতে চায় এসব দেখতে হবে। এখনও নিরাপদ সড়কের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কোন প্রস্তাবনা আসে নাই। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমাদের পাইপলাইনে বিশ্বব্যাংকের সম্ভাব্য প্রকল্প আছে ১৫-১৬টির মতো। সেখানেও এ ধরনের প্রকল্প নেই। বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগের রিপোর্ট নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমি রিপোর্টটি করিনি এবং এখনও দেখিনি তবে পত্রিকায় যতটুকু জেনেছি সেখানে বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ, সড়কের ডিজাইনগুলো যেন নিরপাত্তায় সহায়ক হয় এবং সড়ক নিরাপত্তার জন্য আইন কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ দরকার আছে। যেমন দক্ষ জনবল গড়ে তোলা, ট্রাফিক সিস্টেম গড়ে তোলা। শুধু রাস্তা বানানো তা নয়, অবকাঠামো একটি দিক সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্যান্য দিক যা আছে জনসচেতনা থেকে শুরু করে, আইনের প্রয়োগ, সিগন্যাল সিস্টেম, জেব্রাক্রসিং সবক্ষেত্রেই বিনিয়োগ দরকার আছে। শুধু বিনয়োগ যথেষ্ট অবশ্যই নয়, কি ধরনের বিনিয়োগ করছি, এটি সুপরিকলল্পিত হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। নিরাপাত্তা সবকিছু অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। আমার ধারণা রিপোর্টে অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইনের প্রয়োগ সবকিছু মিলে হয়তো বিনিয়োগ কার্যক্রমে সবকিছুকে কাভার করে। এদিকে, বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তায় টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী কোন কর্মসূচী না থাকা সড়কে উচ্চ মৃত্যু হারের অন্যতম কারণ। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপালের মতো দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত আঞ্চলিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সড়কে উচ্চ মৃত্যুহারের পেছনে গতিগত, লক্ষ্যভিত্তিক ও টেকসই সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের খরাকে দায়ী করে প্রবণতার পরিবর্তনে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব উপ-অঞ্চলে এলাকার সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে গবেষণার অংশ হিসেবে তৈরি এই প্রতিবেদনে সড়ক ও যানবাহনকে আরও নিরাপদ করার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডাইরেক্টর মার্সি মিয়াং টেম্বব বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য রাস্তাঘাট সুরক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটানো একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। এতে দেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করবে। সড়কে দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সরকারকে জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্ঘটনার বর্তমান প্রবণতা কমানো গেলে মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষতির পাশাপাশি দেশের আর্থিক ক্ষতি রোধ সম্ভব হবে। প্রতিবেদনে নিরাপদ সড়ক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে এমন নক্সায় দৃষ্টি দেয়ার ওপর জোর দেয়া হয়েছে, যা সমস্ত সড়ক ব্যবহারকারী ও সব ধরনের গাড়ির চাহিদা পূরণ করবে। নিরাপদ সড়কে অবকাঠামোগত নক্সায় নতুনভাবে ফোকাস করতে হবে। যাতে করে মানুষ, প্রাণী, পথচারী, সাইকেল, রিক্সা, মোটরসাইকেল, মোটরযুক্ত তিন চাকার গাড়ি, গাড়ি, মিনিবাস, বাস, মিনি ট্রাক, ট্রাক এবং কৃষি যানবাহন নিরাপদে চলাচল করতে পারে। নিতান্তই যানবাহনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে মানবকেন্দ্রিক প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেয়া কথা বলা হয়েছে।
×