ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযুক্ত চার যাত্রীকে থানায় তলব

সোনার তরীর ডিসপ্লে মনিটর ভাঙ্গার ঘটনা তদন্তে মাঠে পুলিশ

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১১ জানুয়ারি ২০২০

  সোনার তরীর ডিসপ্লে মনিটর ভাঙ্গার ঘটনা তদন্তে মাঠে পুলিশ

আজাদ সুলায়ান ॥ বিমান বহরে সদ্য যুক্ত হওয়া অত্যাধুনিক ড্রিমলাইনার ‘সোনার তরী’র দুটো ডিসপ্লে মনিটর ভাঙ্গার ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে পুলিশ। এ ঘটনায় অভিযুক্ত চার যাত্রীকে ইতোমধ্যে থানায় তলব করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিমানবন্দর থানায় প্রাথমিকভাবে একটি জিডি করা হলেও তদন্তের পর মামলা দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন। লন্ডন-সিলেট ঢাকা রুটের ওই ফ্লাইটে এ ঘটনা উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, এটা এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা, ইচ্ছে করে গায়ের জোরে টানাটানি করে ডিসপ্লে মনিটর দুটো ভাঙ্গা হয়েছে। এটা মেনে নেয়ার মতো নয়। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকা ম্যানচেষ্টার রুটে সোনার তরী দিয়ে উদ্বোধনী ফ্লাইট অপারেট করা হয়। এতে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন নিজেও যাত্রী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিজি ২০২ ফ্লাইটে লন্ডন থেকে যাত্রী নিয়ে সিলেট হয়ে ঢাকায় আসে সোনার তরী। নতুন বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনারটিতে সর্বমোট আসন সংখ্যা ২৯৮টি। এ উড়োজাহাজে ৩০টি বিজনেস ক্লাস, ২১টি প্রিমিয়াম ইকোনমি ক্লাস এবং ২৪৭টি ইকোনমি ক্লাস সিট রয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর উড়োজাহাজটির ২৬ এ ও ২৬ বি নম্বর সিটের সামনের যুক্ত ইন ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট (আইএফই) সিস্টেমের মনিটর ভাঙ্গা দেখতে পান ক্রু’রা। তাৎক্ষণিক বিমানের উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করা হয়। দুটি সিটের সামনের মনিটর ভাঙ্গা পেলেও দুই সিটের যাত্রী নাকি একজন যাত্রী এ কাণ্ড ঘটিয়েছে তা তাৎক্ষণিক নিশ্চিত হতে পারেনি বিমান। তবে এ বিষয়ে প্রাথমিক খোঁজ খবর নেয়ার পর রাতে ২৬ এ ও ২৬ বি নম্বর সিটের যাত্রীর বিরুদ্ধে জিডি করা হয়। এতে দু’জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তারা হলেন লন্ডন থেকে সিলেট পর্যন্ত ওই সিটের যাত্রী দেলোয়ার হোসেন ও যুবায়ের, আর সিলেট থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসা আসিক ই এলাহী ও আরাফাত হোসেন। প্রত্যক্ষদর্শী একজন কেবিন ক্রু জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, ওই সিটের মনিটর বা ডিসপ্লে এমনভাবে ভাঙ্গা হয়েছে যা আর সহজে মেরামত করা অসম্ভব। কোন সুস্থ মানুষ এমন কা- ঘটাতে পারে না। দেখে মনে হয়, দু’জন যাত্রী ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক যোগে বলপ্রয়োগ করে এগুলো ভেঙ্গেছে। এগুলো আর অপারেট করা যাবে না, অবশ্যই রিপ্লেস করতে হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন জানিয়েছেন, মনিটর দুটোর দাম কমপক্ষে ১৬ লাখ টাকা। তারপরও দেখতে হবে কতটা ক্ষতি হয়েছে। তবে এ দুটো এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে যে কোন সুস্থ’ স্বাভাবিক মানুষও তা সহ্য করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে বিমান প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, বছর আটেক আগে লন্ডন থেকে আসার সময় বিমানের প্রথম বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজের একটি আসনের ডিসপ্লে মনিটর একই কায়দায় ভাঙ্গার সময় হাতেনাতে এক যাত্রীকে ধরে ফেলেন কর্তব্যরত কেবিন ক্রু। ঢাকায় অবতরণের পর ওই যাত্রীকে ধরে বিমান তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ আদায় করে। তবে ওই যাত্রী মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না বলে বিমানের তদন্তে ধরা পড়েছিল। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় জড়িত দুই যাত্রীরও মানসিক সুস্থতা পরীক্ষার দাবি রাখে বলে জানিয়েছে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এ ঘটনায় থানায় জিডি করার পর পুলিশ প্রাথমিকভাবে চার যাত্রীকে সন্দেহের আওতায় রেখে নোটিস পাঠিয়েছে। তাদের বক্তব্য নেয়ার পর প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে ওসি ফরমান আলী । তিনি বলেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি এটা লন্ডন থেকে সিলেট পর্যন্ত, নাকি সিলেট থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসা যাত্রী করেছেন। জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন বলেন, ওই দু’আসনে মোট চারজন ছিলেন। কে ভাঙ্গার সঙ্গে জড়িত তা এখনও সুস্পষ্ট নয়। কারণ এ ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী থাকলে সরাসরি ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের করা হতো। তাই আপাতত প্রাথমিকভাবে জিডি করেছি। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার পর পুলিশই নিয়মিত মামলা দায়ের করবে। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে সিলেট থেকে ওঠা ঢাকার যাত্রীরাই এটি করেছে। মনিটর ভাঙ্গার অপরাধকে শুধু টাকার অঙ্কে বিচার করলে চলবে না। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার বার নতুন নতুন উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর গুরুত্ব ও নির্দেশনা দিচ্ছেন। তারপরও যদি এভাবে যাত্রী ইচ্ছাপূর্বক ঠা-া মাথায় এমন অপরাধ করে সেটা দেশদ্রোহীর সমান। আমরা তাই গুরুত্ব দিয়েই দেখছি এ ঘটনা। উল্লেখ্য লন্ডন ফ্লাইটের যাত্রীরা বেশ উচ্ছৃঙ্খল হিসেবে এ ধরনের ঘটনা আবার ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তারা প্রায়ই ফ্লাইটে ওঠে আপত্তিকর কর্মে লিপ্ত হয় যা উড়োজাহাজের জন্য বেশ ক্ষতিকর। সিলেটি যাত্রীদের প্রাধান্য বিস্তারকারী ওই রুটের ফ্লাইটের ভেতরের অবস্থা সামাল দিতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয় যাত্রীদের। বিমানের ককপিট ও কেবিন ক্রুদের অভিযোগ- সিলেটি যাত্রীরা এতবেশি অসভ্য ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাটাও দুরূহ। বেশি সাবধান করলেও বিপত্তি ঘটে। ওরা লন্ডন ফিরে গিয়ে পাল্টা অভিযোগ ও সলিসটর করে কেবিনক্রুদের হেস্তন্যস্ত করে। আসলে ড্রিমলাইনারের মতো এত উন্নতমান ও অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন উড়োজাহাজ এদের জন্য নয়। এসব মানের উড়োজাহাজের নিউইয়র্ক ও টরেন্টোর মতো রুটের ভদ্র ও সুনাগরিক যাত্রী দরকার। ড্রিমলাইনারের সিটে বসে লন্ডনী সিলেটিরা ইচ্ছেপূর্বক ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হয়। কিছু না করতে পারলেও অন্তত পানের পিক ফেলে পা দিয়ে মুছে বিশ্রী অবস্থার সৃষ্টি করে। বিমান কেবিন ক্রু এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইউসুফ বলেন, লন্ডন ফ্লাইটে এ ধরনের সমস্যা দীর্ঘদিনের। ড্রিমলাইনারের মতো উড়োজাহাজেও যদি এভাবে ক্ষতি করা হয় সেটা কিছুতেই মানার মতো নয়। এখনই সময় কেবিন ক্রুদের সঙ্গে নিয়ে একটা কৌশল বের করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের। এ সম্পর্কে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি ম্যানচেস্টার নামার পর সোনার তরীর অবস্থা দেখে। যাত্রীরা সব নেমে যাবার পর সেখানকার ক্লিনিং কোম্পানির লোকজন ফ্লাইটের ভেতর পরিষ্কার করতে এসে ভয়ঙ্কর চিত্র দেখে মন্তব্য করেছেন, ‘আই ক্যান্ট বিলিভ দ্যাট হিউম্যান বিং ইউজড দিস এয়ারক্রাফট।’ এ অবস্থায় আমি নিজেও লজ্জিত। বিদেশের একজন ক্লিনার যদি আমাদের যাত্রীদের সম্পর্কে এমন মন্তব্য করে সেটা কতটা লজ্জাকর ও দুর্ভাগ্যজনক তা বলাইবাহুল্য। তিনি বলেন, সোনার তরী ও অচিন পাখি একেবারেই নতুন দুটি উড়োজাহাজ বিমান বহরে যুক্ত হয়েছে। যাত্রীদের উন্নতমানের সেবা দিতে বিমানের বহরে উড়োজাহাজ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কোনও যাত্রী যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটান তা দুঃখজনক। এটি মেরামত করতেও সময় লাগবে। এ সময় অন্য যাত্রীরা ইন ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট থেকে বঞ্চিত হবেন। উল্লেখ্য গত ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে ‘সোনার তরী’ এবং গত ২৪ ডিসেম্বর রাত ৮টা ২০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে ‘অচিন পাখি’। এরপর ৫ জানুয়ারি ঢাকা থেকে ম্যানচেস্টারের উদ্দেশে ২৬৮ জন যাত্রী নিয়ে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয় ড্রিমলাইনার সোনার তরীর। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর আবারও ওই রুটে ফ্লাইট শুরু করে বিমান। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহবুব আলী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটের উদ্বোধন করেন। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে উড়োজাহাজ স্বল্পতার কারণে অস্থায়ীভাবে রুটটি বন্ধ রাখা হয়েছিল।
×