ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেয়াদ ফুরানো সিএনজি সিলিন্ডার হলো বিস্ফোরক

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

মেয়াদ ফুরানো সিএনজি সিলিন্ডার হলো বিস্ফোরক

রশিদ মামুন ॥ বেওয়ারিশ সিলিন্ডারে জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে। দেশে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডারের মেয়াদ ফুরালে সেগুলো কি করা হয় তার কোন হিসেব জানে না বিস্ফোরক অধিদফতর এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি (আরপিজিসিএল)। হিসেবের বাইরে থাকা এসব সিলিন্ডারকে বেওয়ারিশ হিসেবেই উল্লেখ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এসব হাই প্রেসার সিলিন্ডারের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত হলেও তার কিছুই করতে পারেনি জ্বালানি বিভাগ। গত ২০ বছর ধরে দেশে সঙ্কুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) বিস্তার ঘটছে। মানুষ এবং পণ্য পরিবহনের একটি বড় অংশ সিএনজি ব্যবহার করছে। কিন্তু নিরাপত্তার ইস্যুতে বরাবরই ঢিলে ঢালা অবস্থায় রয়ে গেছে সরকার। প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, আমরা সিএনজি সিলিন্ডার যারা পুনঃপরীক্ষণ করেন তাদের একটি চিঠি দিয়েছি। এতে সিলিন্ডার স্ক্র্যাপের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী পুনঃপরীক্ষণে ব্যর্থ হওয়া সিলিন্ডারগুলোর তালিকা আমাদের দেয়ার কথা। সিলিন্ডারের মেয়াদ ফুরালে সেগুলো ধ্বংস (স্ক্র্যাপ) করার বিধান থাকলেও আদৌ তা করা হচ্ছে কি না সে বিষয়ে কিছুই জানে না বিস্ফোরক অধিদফতর এবং আরপিজিসিএল। দুই প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরাই বলছে নিয়ম থাকলেও রিটেস্ট সিলিন্ডার এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডারের বিষয়ে কোন তালিকাই পাঠানো হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরের পরিত্যক্ত সিলিন্ডার গ্রামে ব্যবহার হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। গত ৭ নবেম্বর বিস্ফোরক অধিদফতর নাভানা সিএএনটি লিমিটেডকে একটি চিঠি দিয়ে রিটেস্ট বা পুনঃপরীক্ষণে ব্যর্থ সিলিন্ডারগুলো কী করা হয় সে সম্পর্কে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। নাভানা এখনও এই বিষয়ে কোন চিঠি দেয়নি। অন্যদিকে গত দু’দিন আগে আরপিজিসিএল সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বলছে গাড়ির ফিটনেস দেয়ার সময় সিলিন্ডারের মেয়াদ দেখার বাধ্যবাধকতার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছে। সিলিন্ডার বিধিমালা-১৯৯১ তে বলা হয়েছে সিলিন্ডার বিনষ্ট করা হলে বিনষ্ট করার সময় থেকে এক বছর পর্যন্ত তার রেকর্ড রাখতে হবে। এই রেকর্ড প্রতিবছর জানুয়ারী, মে এবং সেপ্টেম্বর মাসে লিখিতভাবে বিস্ফোরক পরিদর্শকের কাছে পাঠাতে হবে। কিন্তু গত ২০ বছর ধরে যে সিলিন্ডারের মেয়াদ শেষ হয়েছে সে বিষয়ে কোন হিসেব বিস্ফোরক অধিদফতরে পাঠানো হয়নি। বিস্ফোরক অধিদফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি এক দিন নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার সময় একটি সিএনজি স্টেশনের পেছনে সিলিন্ডার পড়ে থাকতে দেখেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন এসব সিল্ডিার ব্যবহার অনুপযোগী। তিনি বলেন, ব্যবহার অনুপযোগী সিলিন্ডারগুলোকে স্ক্র্যাপ করার বিধান রয়েছে এর তালিকাও বিস্ফোরক পরিদফতর এবং আরপিজিএসএল এ পাঠানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু এর কোন কিছুই করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, সিলিন্ডার একটি বোমা। এসব সিলিন্ডার কেউ গাড়িতে ব্যবহার করলে বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রাণহানির দায়তো নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরও কিছুটা বর্তায় বলে মনে করেন তিনি। সিলিন্ডার বিধিমালা-১৯৯১’র ৩৪-এ বলা হয়েছে রিটেস্টিং এ কোন সিলিন্ডার অনুপযোগী হলে সিলিন্ডারগুলোকে এমনভাবে খ- খ- করে চ্যাপ্টা করতে হবে যেন খ-গুলো আবার পরস্পর যুক্ত করে নতুন সিলিন্ডার প্রস্তুত করা সম্ভব না হয়। দেশে এখন ৫৪১টি সিএনজি ফিলিং স্টেশন এবং ১৮০টি কনভারশন ওয়ার্কশপ রয়েছে। আর সারাদেশে সিএনজি চালিত গাড়ির সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের মতো। এসব গাড়ির প্রতিটিতে একটি করে সিলিন্ডার থাকলেও সাড়ে পাঁচ লাখ সিলিন্ডার রয়েছে। তবে কোন কোন গাড়িতে তিনটি করেও সিএনজি সিলিন্ডার রয়েছে। কিন্তু আরপিজিসিএল বলছে, এরমধ্যে মাত্র ৯৩ হাজার সিলিন্ডারের রিটেস্টিং করানো হয়েছে। আর সেই রিটেস্টিংও কতটা সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সিএনজি ওনারার্স এ্যাসোনিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, অবশ্যই স্ক্র্যাপ সিলিন্ডারের একটি তালিকা থাকতে হবে। তিনি জানান, তাদের সংগঠনের কাছে কোন তালিকা না থাকলেও এ ধরনের তালিকা তৈরি কোন জটিল বিষয় নয়। তিনি জানান, প্রতিটি সিলিন্ডারের ওপর একটি নাম্বার থাকে। আর সেই নাম্বারে সব কিছুই সংরক্ষিত থাকে। যখন সিলিন্ডারটি স্ক্র্যাপ করা হয় তখন একটি তালিকা রাখলে কিভাবে স্ক্রাপ করা হলো তা থাকা উচিত। দেশের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো বর্তমানে প্রতিমাসে ১১১ দশমিক ৬৮০ এমএমসিএম গ্যাস সিএনজি চালিত যানে ব্যবহৃত হচ্ছে। যানবাহনে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের পরিবর্তে সিএনজি ব্যবহারের ফলে আমদানি খাতে সরকারের প্রতিমাসে এক হাজার ২১১ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। সিএনজির বহুল ব্যবহারের কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন ফর ন্যাচারাল গ্যাস ভেহিক্যাল (আইএএনজিভি) হতে প্রাপ্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী সিএনজিচালিত যানবাহনে মোট সিএনজি ব্যবহারের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশে^ ৯ম এবং যানবাহনের ঘনত্বের হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়ায় ২য় ও বিশে^ ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু এরপরও কোন নজর নেই নিরাপত্তা ইস্যুতে। বিস্ফোরক পরিদফতর এবং আরপিজিসিএল কেউ এ বিষয়ে খুব একটা কঠোর হতে পারেনি। নানামুখী চাপ আর গাড়ি মালিক কর্তৃপক্ষের গাফিলতিও এর জন্য দায়ী। দুর্ঘটনা ঘটার পর আলোচনা হলেও পরে আবার সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়। জানতে চাইলে আরপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, স্ক্র্যাপ সিলিন্ডারের কোন তালিকা আমাদের কাছে কেউ পাঠায় না। তিনি বলেন, আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে বলেছি রিটেস্টিং ছাড়া কোন গাড়ির যেন ফিটনেস দেয়া না হয়। তিনি বলেন, এখন তারা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেই ঝুঁকি কিছুটা কমে আসে। তিনি বলেন, সমস্যা হচ্ছে সিলিন্ডার রিটেস্ট করতে তিন হাজার টাকা লাগে। কিন্তু দেখা যায় ৫০০ টাকা নিয়ে রিটেস্ট না করে কোন কোন প্রতিষ্ঠান সিল সই দিয়ে কাগজ দিয়ে দিচ্ছে। যা ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আমার বলেছি রিটেস্ট করার পর একটি স্টিকার গাড়ির গ্লাসে লাগিয়ে দিতে। এতে সিলিন্ডারের মেয়াদ লেখা থাকবে। মেয়াদ উত্তীর্ণ কোন সিলিন্ডার তাহলে গ্যাস পাবে না। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রেই এত কঠোরতা কাজে আসছে না। এ জন্য সকলকে সচেতন হতে হবে।
×