ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সোনালি সূর্যের আশায় চট্টগ্রাম মোহামেডান

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৩০ অক্টোবর ২০১৯

  সোনালি সূর্যের আশায় চট্টগ্রাম মোহামেডান

একটা সময় দেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা ক্লাব ছিল চট্টগ্রাম মোহামেডান। বন্দরনগরীর ক্লাবটির হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন দেশের কিংবদন্তি ফুটবলাররা। এদের মধ্যে আছেন কাজী সালাউদ্দিন, সালাম মুর্শিদী, বাদল রায়, আরিফ খান জয়, পনির, জাকির, লিটন, নজরুল, সুজন, ইউসুফ, মিঠুনসহ আরও অনেকে। বর্তমানে জাতীয় দলের স্ট্রাইকার নাবীব নেওয়াজ জীবনও খেলেছেন চট্টগ্রাম মোহামেডানে। কিন্তু সম্প্রতি ক্লাবটি অতলে হারিয়ে গেছে। তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চট্টগ্রাম আবাহনী যেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্যে উদ্ভাসিত হচ্ছে সেখানে মোহামেডান ক্লাবে ঝুলছে তালা। শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবল নিয়ে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন এখন উৎসবমুখর। বিশেষ করে আয়োজক চট্টগ্রাম আবাহনী। ঠিক এই মুহূর্তে উল্টো চিত্র একসময় তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব চট্টগ্রাম মোহামেডানের। কয়েক বছর আগে থেকেই রুগ্ন হয়ে পড়া সাদা-কালো শিবিরে সবশেষ ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির পর তালা ঝুলছে। সরেজমিন বন্দরনগরীর সদরঘাটে অবস্থিত মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবে যেয়ে দেখা যায় করুণ চিত্র। ছবিতেই বিষয়টা স্পষ্ট। ক্লাবের সঙ্গে সেপ্টে আছে ফলের দোকান আর টি স্টল। ক্লাব যেমন আইসিইউতে চলে গেছে তেমনি দোকানগুলোরও রুগ্ন দশা! এখন ক্লাবের শুধু সাইনবোর্ডটাই আছে। আর সবকিছুতেই স্থবিরতা। আগে থেকেই জীর্ণ দশা হওয়া ক্লাবটি ক্যাসিনো অভিযানের পর থেকে গহ্বরে ঢুকে গেছে। চায়ের দোকানি বললেন, ‘এখন আর এখানে কেউ আসে না। মনে হয় না এই তালা আর খুলবে’। মোহামেডানের একনিষ্ঠ ভক্ত-সমর্থক কামরুল ইসলাম মামুন। নগরীর আগ্রাবাদের এই বাসিন্দা একটা সময় মোহামেডানের প্রতিটি খেলাতেই মাঠে থাকতেন। কিন্তু এখন আর মন টানে না। টানবে কি। তার প্রিয় দল তো মাঠের খেলাতেই নেই! প্রাণের ক্লাবের কথা মনে হলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে তার মনটা। প্রায় ১০ বছর পর ক্লাব প্রাঙ্গণে যেয়ে তরুণ এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভাবতেই কষ্ট হয় মোহামেডানের এমন অবস্থা। একটা সময় প্রতিদিন ক্লাবে আসতাম। সব ধরনের খেলায় মাঠে যেতাম। আর আজ ক্লাবের কিছুই নেই’। বর্তমানে চট্টগ্রাম মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের প্রধান সমন্বয়করী তৌহিদুল ইসলাম সিদ্দিকী। সাবেক এই ফুটবলারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে ক্লাবের এমন ভগ্ন দশায় কষ্ট পান বলে জানান। ক্লাবের অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক ও শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবলের ভেন্যু কমিটির সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ ক্লাব বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আসলে ক্যাসিনো অভিযানের কারণে আমাদের বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু ক্লাবের কার্যক্রম ঠিকই চলছে।’ ভাল দল গড়তে না পারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক পলিটিক্সের মধ্যে টিকে থাকতে হচ্ছে। আমাদের দুইটা দল। মোহামেডান আর মোহামেডান ব্লুজ। মোহামেডান ব্লুজ প্রিমিয়ার লীগে খেলছে। বর্তমানে তৃতীয় স্থানে আছে।’ ক্লাবের রুগ্ন দশার জন্য স্পন্সরের অভাবকে দায়ী করে ইউসুফ বলেন, ‘ভাল স্পন্সর না পেলে ক্লাব চালানো খুব কঠিন। এরপরও ক্লাবের নেতৃবৃন্দ চেষ্টা করছেন ক্লাবটিকে ভাল অবস্থানে নিয়ে যেতে। আবাহনীর (চট্টগ্রাম আবাহনী) সৌভাগ্য যে, তারা ভাল একটা স্পন্সর পেয়েছে। তা না হলে তাদেরও আমাদের মতো অবস্থা হয়ে যেত’। চট্টগ্রাম মোহামেডান ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাব উদ্দিন শামীম। তিনি চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন। চট্টগ্রামের এই নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠক মোহামেডান ক্লাবে তালা লাগানো প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ক্যাসিনোর কারণে ক্লাব বন্ধ না। ক্যাসিনো কা-ের সময় সব ক্লাবে তালা লাগানো হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ক্লাবে নয়। আমরা নিজেরাই তালা লাগিয়েছি।’ কবে নাগাদ ক্লাবের তালা খোলা হবে, ‘নাসিরাবাদ আমার বাসা। আমাদের ক্লাব হচ্ছে সদরঘাট। স্বাভাবিকভাবেই লোকাল লোকজনের প্রভাব থাকে। এটা আমাদের কমিটির লোকজনের ভেতরেও আছে। সেখানে যদি আমি খুলে দিই তাহলে প্রথমে বলবে আমরা বসব, তারপর বলবে লুডু খেলব, তারপর তাস। তখন মনে হবে এটা আমাদের কমিটি থেকেই অনুমোদন দিয়েছি।’ বর্তমানে ক্লাবের স্টাফদের ছুটি দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেশ সফল শাহাব উদ্দিন। কিন্তু মৃত মোহামেডানকে জাগাতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম মোহামেডান ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। সব ধরনের ইভেন্টে আমরা শিরোপার জন্য দল গড়ি। কিন্তু বাকিটা ভাগ্যের ব্যাপার।’ বর্তমানে প্রিমিয়ার লীগে না থাকা প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘এখন কর্পোরেট হাউসগুলো ফুটবলে ঢুকছে। যাদের বাজেট অনেক বড়। সে তুলনায় আমাদের বাজেট খুবই কম।’ তাহলে চট্টগ্রাম আবাহনী কিভাবে পারছে, ‘তারাও একটা কর্পোরেট হাউসের স্পন্সর পেয়েছে। এ কারণেই তারা ভাল করছে।’ তাহলে আপনারা কেন স্পন্সর পাচ্ছেন না? ‘যে কোন মোহামেডানকে অন্য একটা রাজনৈতিক দলের ক্লাব মনে করা হয়। তাই আগে যারা ডোনার ছিল, তারা এখন আসতেই চাই না। তারা ভয় পায় যে প্রশাসন যন্ত্র অন্য রাজনৈতিক দলের মনে করে কিনা।’ বর্তমানে চট্টগ্রাম মোহামেডানের দুটি দল। মোহামেডান আর মোহামেডান ব্লুজ। এটা কেন হলো জানতে চাইলে শামীম বলেন, ‘চিটাগাং মোহামেডান চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার লীগ থেকে ঢাকায় চলে যাওয়ার পর মূলত মোহামেডান ব্লুজ গঠন করা হয়। যেন আমরা দুই লীগেই খেলতে পারি।’ এখন যে অবস্থা তাতে তো দুই ক্লাবকে এক করা যায়, ‘দুই ক্লাবই কিছু কিছু আলাদা আলাদা ইভেন্টে খেলে। এই যে বেশি খেলছি এই কারণে সিজেকেএস ক্রীড়াসংস্থায় প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে।’ নানা প্রতিকূলতার পরও সহসা ঢাকার ফুটবলে ফেরার স্বপ্ন বুনছেন মোহামেডানের এই শীর্ষ কর্তা, ‘স্পন্সর জোগাড়ের প্রক্রিয়া চলছে। আগামী দুই এক মৌসুমের মধ্যেই আবারও ফিরব ঢাকার ফুটবলে।’ চলমান শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবলের কো-অর্ডিনেটর শাহাব উদ্দিন। অথচ তার নিজের ক্লাব চট্টগ্রাম মোহামেডান খেলছে না। বিষয়টা ব্যথিত করে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্পোটিং দিক দিয়ে ভাবলে অবশ্যই খারাপ লাগছে। তবে আরেক দিক দিয়ে ভাল লাগছে, এই আসর আয়োজন করছে আমাদেরই চট্টগ্রামের ক্লাব। বর্তমান হুইপের কারণেই টুর্নামেন্টটি হচ্ছে। তবে আমাদের টার্গেট আছে। আগামী দুই এক বছরের মধ্যে ভাল দল গড়তে পারলে এ ধরনের টুর্নামেন্টে খেলার ইচ্ছে আছে।’ মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব চট্টগ্রাম বন্দরনগরীর অন্যতম প্রধান ক্রীড়া ক্লাব। ক্লাবটি ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলাদেশের পেশাদার লীগের সবচেয়ে বড় আসর বিপিএলের প্রথম আসরে চট্টগ্রাম মোহামেডান হয়েছিল ষষ্ঠ। এরপর দ্বিতীয় আসরে পঞ্চম ও তৃতীয় আসরে হয় নবম। ২০১১ সালে চতুর্থ আসরে বাংলাদেশ লীগ থেকে অবনমন ঘটে দলটির। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ৬৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। প্রধান লীগ থেকে অবনমন হওয়ার পর মোহামেডান খেলে চ্যাম্পিয়নশিপ লীগে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে ব্যর্থ হয়ে এই আসর থেকেও অবনমন হয় তাদের। এরপর থেকে সবখানেই বিরাজ করছে স্থবিরতা। তবে মোহামেডান ব্লুজ নামে আরেকটি দল গঠন করে সেই দলটির মাঠের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন ক্লাবটির কর্তারা। বর্তমানে চট্টগ্রাম লীগে মোহামেডান ব্লুজের অবস্থান তৃতীয়। অর্থাভাবে গত ছয় বছর ধরে প্রতিযোগিতামূলক কোন টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে না চট্টগ্রাম মোহামেডান। অবস্থা থেকে বের হতে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও শিল্পগোষ্ঠীর দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছেন ক্লাবটির কর্তা ব্যক্তিরা। কিন্তু এখনও আলোর মুখ দেখেনি তাদের প্রচেষ্টা। একটা সময় চট্টগ্রামের ফুটবলের প্রতিনিধিত্ব করত মোহামেডান। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯ বার চট্টগ্রাম লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সাদা-কালো জার্সিধারীরা। এর মধ্যে ২০০৩-০৬ মৌসুমে চারবার টানা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবেও ভাসে দলটি। পাশাপাশি চট্টগ্রাম লীগে চারবার রার্নাসআপ হয়েছে। ২০০৯ সালে সাড়া জাগানো সুপার কাপে সেমিফাইনাল খেলেছিল চট্টগ্রাম মোহামেডান। কোটি টাকার ওই টুর্নামেন্টে ঢাকা মোহামেডানের পরিবর্তে ফাইনাল খেলতে পারত চট্টগ্রাম মোহামেডানও। সেমির প্রথম লেগে চট্টগ্রাম মোহামেডানকে ১-০ গোলে হারালেও দ্বিতীয় লেগে একই ব্যবধানে জয় পায় বন্দরনগরীর মোহামেডান। এরপর ভাগ্যনির্ধারণী টাইব্রেকারে হেরে যায় চট্টগ্রামের ক্লাব। শুধু তাই নয়, নিটল টাটা জাতীয় লীগেও সেমিফাইনালে খেলেছে চট্টগ্রাম আবাহনী। অথচ সময়ের কি নিষ্ঠুর পরিহাস। শুধু চট্টগ্রামেরই নয়, দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্লাবটি ধীরে ধীরে স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন হারিয়ে গেছে নওজোয়ান, রিজেন্সির মতো ক্লাবগুলো। একটা সময় এসব ক্লাব শাসন করত চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন। সাবেক ফুটবলার ও চট্টগ্রাম মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্য মাসুদুর রহমান মাসুদ জানিয়েছেন ক্লাবে কোন রাজনীতি নেই। তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে কোন রাজনীতি নেই ক্লাবে। কেউ এটা বোঝাতে চাইলেও বিষয়টা সত্যি নয়। যারা খেলাপ্রেমী, মোহামেডানকে ভালবেসে সমর্থন করেন তারা ক্লাব অফিসিয়াল হয়ে ডোনেশন দেয়। জাতীয় কর্মসূচীগুলো পালন করে।’ মাসুদুর রহমানের বাবা প্রয়াত আবু জাফর স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম মোহামেডানের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে ১৯৬২ সাল থেকে তিনি চট্টগ্রাম মোহামেডানের হয়ে খেলেন। তখন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব পরিচালিত হতো আন্দারকিল্লা বর্তমান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আলহাজ আ.জ.ম নাছিরের বাসার সামনে থেকে। বর্তমান মোহামেডানের নাজুক অবস্থা দেখে ব্যথিত মাসুদুর রহমান বলেন, ‘কিছু অশুভ শক্তি রাজনীতির ছত্রছায়ায় ক্রীড়াঙ্গনকে জিম্মি করে ফেলেছে। ঢাকা যে ক্যাসিনো দেখে অবাক হয়েছি, ক্যাসিনোর লুটেরা অবৈধ টাকার। অবৈধ ব্যবসা সারা দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে ধ্বংস করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্রীড়াঙ্গনকে রাজনীতি ও দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ক্রীড়ামোদী ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের সেখানে জায়গা করে দিতে হবে। তারা আজ অবহেলিত। নির্বাক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।’
×