ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জমি রেজিস্ট্রেশন থেকে পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার মতো সেবা পেতে ঘুরতে হয় এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ;###; ‘স্পিড মানি’ না দিলে ফাইল লালফিতায় বন্দী

শুরুতেই ১৫ বাধা ॥ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কবলে উদ্যোক্তা

প্রকাশিত: ১০:৫০, ২৮ অক্টোবর ২০১৯

শুরুতেই ১৫ বাধা ॥ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কবলে উদ্যোক্তা

এম শাহজাহান ॥ একজন উদ্যোক্তা বিনিয়োগের শুরুতে প্রায় ১৫ ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। জমি রেজিস্ট্রেশন থেকে পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার মতো ১৫ ধরনের সেবা পেতে তাকে ঘুরতে হয় এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে। ‘স্পিড মানি’ না দিলে লাল ফিতায় বন্দী থাকে বিনিয়োগের ফাইল। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। অথচ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে প্রায় ২৭ ধরনের সেবা এক ছাতার নিচ থেকে দেয়ার জন্য করা হয়েছে ‘ওয়ানস্টপ’ সার্ভিস আইন। কিন্তু আইনটি এখনও পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। ওয়ানস্টপ সার্ভিস পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিতে অবকাঠামোগত খাতে সরকারী বিনিয়োগ বাড়লেও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি। অন্যদিকে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিনিয়োগ আকর্ষণে ‘ব্যবসা সহজীকরণ’ সুযোগ সৃষ্টির তাগিদ দিচ্ছেন বিদেশী উদ্যোক্তারা। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পরই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় জমি সঙ্কট নিরসনে করা হচ্ছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। মূলধন প্রাপ্যতা সহজ করতে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোসহ অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার এই উদ্যোগগুলো গ্রহণ করে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সরকারের এসব উদ্যোগ পুরোপুরি কার্যকর হতে পারছে না। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের উদ্যোগের কোন ঘাটতি নেই- মূল সমস্যা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলো দূর হলে বিনিয়োগের উর্বর ভূমি হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ। বাড়বে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ। জানা গেছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে প্রায় ১৫ ধরনের আমলাতান্ত্রিক বাধা রয়েছে। আমলাতন্ত্রের এই কঠিন ফাঁদে আটকে আছে বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে সরকারের ঘোষিত বিনিয়োগ পলিসি বাস্তবায়ন করতে হলে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সব ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে বিডা ঘোষিত ‘ওয়ানস্টপ’ সার্ভিস বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুতের পূর্ণ নিশ্চয়তা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে নির্ধারণ করা, সরকারী অফিসগুলোতে কার্যকরভাবে ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করা, ঢাকার বাইরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ প্যাকেজ সুবিধা চালু, বিশেষ বিশেষ শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা প্রদান, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, ইউটিলিটি সার্ভিসসহ দ্রুত অর্থনৈতিক জোনগুলো তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এছাড়া অর্থনৈতিক নীতিসমূহ শিল্প, বাণিজ্য, রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে শিল্প সহায়ক পলিসি গ্রহণ করা প্রয়োজন। সুদের হার ১০ বছরের জন্য ৯ শতাংশ করতে হবে। তিনি বলেন, উচ্চ সুদ দিয়ে কখনও কোন দেশে শিল্পায়ন হয়নি, বাংলাদেশেও হবে না। বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। বেসরকারী বিনিয়োগের অন্যতম পথ অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধিসহ ব্যবসা ব্যয় কমিয়ে আনা। তিনি বলেন, এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহ হলো শিল্প স্থাপনের জন্য ভূমি প্রাপ্তি, আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন, দুর্নীতি হ্রাসে ক্ষতিহ্রাস কৌশল, বিদ্যুত জ্বালানির সহজলভ্যতাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধা সৃষ্টি, বাংক-বীমা কাস্টমসহ দলিল দস্তাবেজ প্রক্রিয়াকরণ সহজ করা এবং ব্যবসা দ্রুতায়ন প্রক্রিয়া সহজ করা। জানা গেছে, রূপকল্প ভিশন-২১ বাস্তবায়ন, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। এ লক্ষ্যে সপ্তম পঞ্চমবার্ষিকীতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ লাখ কোটি টাকা। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে ১ কোটি ২৯ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছে সরকার। শুধু তাই নয়, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচী। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেশে এখনও ওয়ানস্টপ সার্ভিস আইন কার্যকর হতে পারেনি। বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবা নিতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। জানা গেছে, বিনিয়োগের প্রধান বাধাগুলো দূর করতে বেশকিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে না। এ কারণে দেশে সরকারী বিনিয়োগ যেভাবে বাড়ছে সেই তুলনায় গত কয়েক বছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি। বিদেশী বিনিয়োগে সরকারের সন্তুষ্টি রয়েছে। কারণ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো নিয়ে আগ্রহ রয়েছে তাদের। অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। সামনে চীন, জাপান, ভারত, রাশিয়া ও সৌদি আরবের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ হবে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে। বিদেশী বিনিয়োগের জন্য দেয়া হবে পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, নানা ধরনের অযৌক্তিক কারণেও দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এসব ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হলে বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এ কারণে ব্যবসায় সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার জন্য সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিভিন্ন প্রকার রেজিস্ট্রেশন ফি উল্লেখযোগ্য হারে কমানো হয়েছে এবং ৫০ হাজার টাকার নিম্ন মূলধনসম্পন্ন কোম্পানির ক্ষেত্রে তা শূন্য করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, বিনিয়োগ সংক্রান্ত অন্য প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্রুত ও সহজলভ্য করার জন্য ওয়ানস্টপ (ওএসএস) সার্ভিস চালু করা হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় ওয়ানস্টপের আদলে বিনিয়োগ সেবা প্রদান তদারকি করবে সরকার। জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২১-২২ শতাংশের মধ্যে সীমিত রয়েছে। অথচ কর্মসংস্থান ও কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে এ হার জিডিপির ২৭ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। যদিও এই সময়ে সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রয়োজন। এজন্য সরকার বাংলাদেশে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৬ জারি করেছে। এ আইনের বিধানমতে, বিনিয়োগ বোর্ড ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের কার্যক্রম একীভূত করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) গঠন করা হয়। এ প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে সরাসরি বিনিয়োগের পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ অপসারণে কাজ করছে। ওয়ানস্টপ সার্ভিস আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যা মহান জাতীয় সংসদে পাসও হয়েছে। তিনি বলেন, এ আইন অনুযায়ী একজন বিনিয়োগকারীর প্রয়োজনীয় আন্তঃমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সকল সেবা কর্তৃপক্ষ নিজেই সম্পাদন করবেন। এভাবে একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব নয় মাসের মধ্যে কার্যকর করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, শিল্প-কারখানায় বিদ্যুতের সংযোগ পেতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে লাগে ১০৬ দিন, আর বাংলাদেশে ৪২৯ দিন। ভারতে ৪৭ দিনে জমির নিবন্ধন পাওয়া গেলেও এদেশে লাগে ২৪৪ দিন। এছাড়া ভারতে ফুটপাথের একজন ব্যবসায়ীকে দৈনিক ১০ টাকা চাঁদা দিতে হলেও বাংলাদেশে এ হার ১২০ টাকা। এছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রে লেনদেনের ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বমানের ব্যবসায়িক পরিবেশের সৃষ্টি না হলে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আসবে না। সংস্থাটির মতে, র‌্যাংক অব ডুয়িং বিজনেস-এ দেশের অবস্থান আরও উন্নত করতে হবে, এতেই বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান তিন অঙ্কের ঘরে রয়েছে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই অবস্থান দুই অঙ্কের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। এদিকে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হলে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে মনে করে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটি বরাবরই বেসরকারী ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে হলে আগে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের মাধ্যমেই উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। এ কারণে বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া ওয়ানস্টপ সার্ভিস দ্রুত কার্যকরে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। জানা গেছে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাণিজ্য বিষয়ক আরও তিন আইন যথা- কোম্পানি আইন, বাণিজ্য সংগঠন আইন এবং সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন এ্যাক্ট প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
×