ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধির রূপ নিচ্ছে

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধির রূপ নিচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ ভয়াবহ দিনে দিনে সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। কোন কিছুতেই এই ব্যাধি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু ধর্ষণে এই অপরাধ সীমাবদ্ধ নেই। ধর্ষণের মতো অপরাধ আড়াল করতে ধর্ষিতাকে অধিকাংশ সময়ই নির্মম নির্যাতনের পর হত্যার ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন গড়ে সারাদেশে অন্তত চার থেকে পাঁচটি ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। যদিও সারাদেশে প্রতিদিন নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের হচ্ছে শতাধিক। হালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অধিকাংশ ঘটনাই প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। আলোচিত ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতারও হচ্ছে। কোন কোন আসামি গ্রেফতার অভিযানকালে মারাও যাচ্ছে। তারপরও থেমে নেই ধর্ষণের মতো অপরাধ। ভাইরাসের মতো সমাজের সকল স্তরে এই ব্যাধি বাসা বাঁধছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একমাত্র সচেতনতাই পারে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনতে। সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব না হলে এ ধরনের অপরাধ সমাজ থেকে দূর করা কঠিন হবে। ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত খুনের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এতে ভয়ে হলেও সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ কিছুটা কমে আসবে। এ ধরনের অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তি বা তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দোষীদের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। এতে করে কেউ এ ধরনের অপরাধের শিকার হলে মুখ খুলবে। আইনের আশ্রয় নেবে। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান মোতাবেক, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ঢাকার গে-ারিয়ায় ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে আয়েশা নামের এক শিশুকে বাড়ির তিনতলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ডেমরার কোনাপাড়ার একটি বাসায় লিপস্টিক দেয়ার লোভ দেখিয়ে ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত জাহান (৪) নামে দুই শিশুকে ডেকে বাসায় নিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক গোলাম মোস্তফা (২৮) ও তারই মামাত ভাই আজিজুল বাওয়ানী (৩০) কর্তৃক হত্যা, চলতি বছরের ৫ জুলাই ঢাকার ওয়ারীতে সিলভারডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্রী সামিয়া আফরিন সায়মাকে (৭) ধর্ষণের পর গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া এ বছরের ২৭ জানুয়ারি আশুলিয়ায় নয় বছর বয়সী এক ছাত্রীকে মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষণের পর তার ভিডিও ধারণ করে বার বার ধর্ষণ করার ঘটনা, গাজীপুরে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা, ওয়ারীতে ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বার বার এক তরুণীকে ধর্ষণ করার ঘটনাও তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এসব ঘটনাই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলেও সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ফেনীর নুসরাত হত্যাকা-ের ঘটনা। চলতি বছরের ২৭ মার্চ ফেনীর সোনাগাজি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে গ্রেফতার হয় মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অধ্যক্ষের নির্দেশে রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা যা বলেন শিশু, কিশোর, কিশোরী, তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষের যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের নির্মম হত্যাকা-ের বিষয় সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলছেন, অপরাধ করা একটি মানসিক বিষয়। অনেক অপরাধ পরিবেশ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঘটে বা করে থাকে। কিন্তু ধর্ষণ, নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধ পুরোটাই মানসিক বিষয়। সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া সমাজে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা কঠিন কাজ। মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। নিজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সচেতন ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ধর্ষণ করা বা ধর্ষণের পর তার ভিডিও ধারণ করে তার সুযোগ নিয়ে বার বার সুবিধা নেয়ার বিষয়টিও নিছক এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা। ধর্ষণের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রয়োজনে পাড়া মহল্লায় সভা সমাবেশ করে মানুষকে বুঝানো প্রয়োজন। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পাঠদানের মাধ্যমে এসব বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজের মানুষদের সচেতনতা করা দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের রীতিমতো এসব বিষয়ে সর্তকতামূলক শিক্ষা দেয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পিতামাতা ও পরিবারের সদস্যদের শিশু, নারী বা অন্য যারা পরিবারের সদস্য তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তার সন্তানের ওপর আপশাশের কারও কোন কুনজর আছে কি না তা খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সন্তানকে কে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। সন্তান কোন কোন জিনিস বা বিষয়ের প্রতি দুর্বল তা জানতে হবে। প্রয়োজনে পরিবারকে সন্তানের যেসব চাহিদা সাধ্য মোতাবেক পূরণ করতে হবে। সন্তানদের নানা বিষয়ে সর্তকতামূলক বিষয়াদি শেখাতে হবে। তাহলেই এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। আজ প্রযুক্তির কারণে অনেক খারাপ জিনিস হাতের নাগালে চলে এসেছে। যার কারণে বিশ্বের অন্য দেশের মতো পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটছে। প্রযুক্তির কারণে মানুষ যেন নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ভুলে না যায়, তা শেখাতে হবে। ছেলে মেয়েরা যাতে পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা প্রয়োজন প্রতিটি পরিবারে। এতে করে ছেলে মেয়েদের বিপদগামী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। যখন কোন সন্তান তার পরিবারের কাছে তার অভাব বা ব্যক্তিগত বিষয়াদির কথা প্রকাশ করতে না পারে, তখন স্বাভাবিক কারণেই সে বন্ধু বা বান্ধবী বা পরিচিতদের কাছে যায়। আর তখনই তার বিপদগামী বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধর্ষণের মতো অপরাধগুলোও সংঘটিত হয় এভাবেই। সম্প্রতি আদালত এ ধরনের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে ধর্ষণ বা নিপীড়নের মতো অপরাধ দিন দিন কমে যাবে। পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে তারা যখন বিভিন্ন সভা সমাবেশে যান, তারা এসব বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে এবং পাশাপাশি আইনে কঠোর শাস্তির কথা জানালে এ ধরনের অপরাধ কমে আসার ক্ষেত্রে আরও সুফল আসবে। পাশাপাশি মামলা দায়েরকারী বা ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দোষীদের নিয়মিত মনিটরিং করা জরুরী। এটি ধর্ষণের মতো অপরাধ সমাজ থেকে কমিয়ে আনতে কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। অনেক আসামি জামিনে যাচ্ছে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা যখন ঘটছে, তখন খুবই তোলপাড় হচ্ছে। মামলার আসামিরা গ্রেফতার হচ্ছে। অথচ আসামিরা অনেক সময়ই প্রভাব খাটিয়ে উপযুক্ত প্রমাণাদির অভাবে জামিনও পেয়ে যাচ্ছে। তাদের বিষয়ে আর মনিটরিং করা হয় না। বা যাদের মনিটরিং করার কথা, তারা সে কাজটি ঠিকমতো পালন করেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার তদন্তে গাফিলতি করলে ওইসব পুলিশ সদস্যের চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
×