ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ফরএভার’ যেন আরেক ডেসটিনি

প্রকাশিত: ১১:১২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

‘ফরএভার’ যেন আরেক ডেসটিনি

রহিম শেখ ॥ এ যেন ডিজিটাল প্রতারণা। মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের আদলে ‘নেটওয়ার্ক মার্কেটিং’। এই মার্কেটিংয়ে যুক্ত হতে কিনতে হবে ২৫ হাজার ৫০০ টাকার ‘কম্বো প্যাক’। এই প্যাকের পণ্য বলতে, ঘ্রীত-কুমারী বা ‘এলো ভেরা’ দিয়ে তৈরি প্রসাধন সামগ্রী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ। এরপর নিচের সারিতে ক্রেতা যুক্ত হলে মিলবে পণ্য বিক্রির ওপর বিশেষ কমিশন। ধাপে ধাপে মিলবে ‘নোভাস কাস্টমার’, ‘এসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজার’, ‘সুপারভাইজার’ ‘এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার’ ও ‘ম্যানেজার’ পদ। সেই সঙ্গে ভাগ্যে জুটবে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সুযোগ। এমন লোভনীয় অফার দিয়ে অভিনব এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ‘নোভেরা প্রোডাক্টস লিমিটেড বাংলাদেশ’ নামের একটি কোম্পানি। রাজধানীর কাওরান বাজারের যে ভবনটিতে একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) কার্যালয় রয়েছে ওই ভবনের দোতলায় অফিস নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রসাধনী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ উচ্চ দামে সদস্যদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা। আর ভবিষ্যত আয়ের আশায় তাদের সেই পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন বেকার যুবক-যুবতীরা। এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনিও একই আদলে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনি এই কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করা না গেলে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাবে। পাশাপাশি দেশের যুবক-যুবতীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পরিচয় গোপন করে জনকণ্ঠের এ প্রতিবেদক গত বৃহস্পতিবার ফরএভার লিভিং প্রডাক্টসের কাওরান বাজার কার্যালয়ে যান। কার্যালয়ে ঢুকেই চোখে পড়ল দেয়ালে টানানো নানা ধরনের সার্টিফিকেট। সিটি কর্পোরেশন, বিএসটিআই ও কোম্পানির প্রধান অফিস কর্তৃক প্রশংসাপত্র। অফিসের এক পাশে রয়েছে পণ্যের স্টোর রুম। তখন অপরপাশের সেমিনার কক্ষে চলছিল কোম্পানির পণ্যের ওপর বিশেষ ট্রেনিং। ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে দেখা গেল ৩০-৩৫ জন তরুণ-তরুণীকে। ট্রেনিং করাচ্ছিলেন কোম্পানির ‘ঈগল ম্যানেজার’ পদবি নূসরাত জাহান সাথী নামের একজন তরুণী। স্ট্রেজে দাঁড়িয়ে সবাইকে জানালেন, ২০১৭ সালে কোম্পানিতে জয়েন করেছেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফর করে কোম্পানির পক্ষ থেকে অর্জন করেছেন ‘প্রাইভেট কার’। ট্রেনিং শেষে কথা হয় নূসরাত জাহান সাথীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, সদস্য হতে হলে ছবি ও ভোটার আইডি কার্ড লাগবে এবং ২৫ হাজার টাকার পণ্য কিনতে হবে। ওই পণ্য কিনলে তার পদবি হবে এসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজার। এই পদে উপনীত হয়ে যে কেউ পণ্য কিনে ৩৫ শতাংশ কমিশন পাবেন। সেই সঙ্গে তার অধীনের নোভাস কাস্টমাররা যে পরিমাণ পণ্য কিনবেন তার ওপর থেকে পাবেন ১৫ শতাংশ কমিশন। আর একজন এসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজার হওয়ার এক মাসের মধ্যে অথবা দুইমাসের মধ্যে নিজে অথবা নতুন কোন গ্রাহক দিয়ে ২৫ সিসি পণ্য কিনলেই হয়ে যাবেন সুপারভাইজার। এই পদে উপনীত হয়ে পণ্য কিনলেই পাওয়া যাবে ৩৮ শতাংশ কমিশন। সেইসঙ্গে নোভাস কাস্টমার দিয়ে পণ্য ক্রয় করলে ১৫ শতাংশ এবং অধীনস্থ এসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজারদের বা তাদের গ্রুপের ক্রয়ের ওপর ৩ শতাংশ কমিশন পাওয়া যাবে। সুপারভাইজার হওয়ার পর দুই মাসের মধ্যে নিজে অথবা অন্যদের মাধ্যমে ৭৫ সিসি পণ্য কিনলেই এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে যাবেন। এই পদ অর্জনকারীরা পণ্য কিনলে ৪৩ শতাংশ কমিশন পাবেন। সেইসঙ্গে নোভাস কাস্টমারের কাছে পণ্য বিক্রি থেকে ১৫ শতাংশ এবং অধীনস্থ এসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজারদের ক্রয়ের ওপর ৮ শতাংশ কমিশন পাওয়া যাবে। এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হওয়ার পর দুই মাসের মধ্যে নিজে অথবা অন্যদের মাধ্যমে ১২০ সিসি পণ্য কিনলেই ম্যানেজার পদে পদোন্নতি হবে। এই পদবিধারীরা নিজে পণ্য কিনলে ৪৮ শতাংশ কমিশন পাবেন। সেইসঙ্গে কোন নোভাস কাস্টমার দিয়ে পণ্য কেনালে ১৫ শতাংশ এবং অধীনস্থ এসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজারদের বা তাদের গ্রুপের কেউ পণ্য কিনলেই তার ওপর ১৩ শতাংশ কমিশন মিলবে। পদোন্নতি ও কমিশন পাওয়ার এই বর্ণনা দেয়ার পর নূসরাত বলেন, ২৫, ৭৫ এবং ১২০ সিসি বেশি মনে হলেও এটি অর্জন করা খুব কঠিন কিছু না। কারণ ম্যানেজার পদে উন্নীত হওয়াদের অধীনে একাধিক এসিস্ট্যান্ট ম্যনেজার, সুপারভাইজার, এসিসট্যান্ট সুপারভাইজার থাকেন। তাদের পারফরমেন্স অর্থাৎ তাদের ক্রয় বা নোভাস কাস্টমারদের ক্রয়ের সুফলও পান ম্যানেজাররা। একইভাবে এসিস্ট্যান্ট ম্যনেজার, সুপারভাইজার, এসিট্যান্ট সুপারভাইজাররাও তাদের অধিনস্তদের ক্রয়ের সুবিধা পাবেন। নূসরাত আরও বলেন, নিয়মিত কমিশন পেতে প্রত্যেক পদের জন্যই মাসে কমপক্ষে ৪ সিসি পণ্য কিনতে হবে। এর মধ্যে নিজের ব্যবহারের জন্য কমপক্ষে ১ সিসি পণ্য কিনতে হবে। বাকি ৩ সিসি নিজেও কেনা যাবে অথবা অন্য কারও কাছে বিক্রি করতে হবে। কথা হয় মোহাম্মদ সরওয়ার হোসেন নামের একজন ম্যানেজারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, যত দ্রুত কাজ শুরু করবেন ততই লাভ। অন্যদের কাছে পণ্য বিক্রি করলে যেমন কমিশন পাবেন, তেমনি নিজে পণ্য কিনেও কমিশন পাবেন। যত পণ্য বিক্রি করতে পারবেন ততই লাভ। ফরএভারের লিভিং প্রডাক্টসের প্রধানের নাম জানতে চাইলে সরওয়ার বলেন, ফরএভার ওয়াল্ড ওয়াইড কোম্পানি। বাংলাদেশের প্রধান এম বদরুল ইসলাম, যার পদবি কান্ট্রি সেলস ম্যানেজার। এরপর সরওয়ারের মাধ্যমে দেখা হয় এম বদরুল ইসলামের সঙ্গে। ওই সময় ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলতে চাননি বদরুল ইসলাম। এরপর জনকণ্ঠের পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে কথা হয় এম বদরুল ইসলামের সঙ্গে। এমএলএম ব্যবসার সনদ ছাড়াই আপনারা কীভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন? উত্তরে বদরুল বলেন, ‘আমরা আদালতে রিট করে ব্যবসা চালাচ্ছি।’ গ্রাহকদের অধিক আয়ের প্রলোভন দেখানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা কাউকে আয়ের পথও দেখাই না ব্যয়ের পথও দেখাই না। আমরা পণ্য বিক্রির ওপর কমিশন দিয়ে থাকি। আমাদের সদস্য হলে অধিক আয় করা যাবে এমন কথা আমরা কাউকে বলি না।’ এরপর তিনি বলেন, ‘আমি এখন ব্যস্ত আছি, সব কথা মোবাইলে বলা সম্ভব না। আপনি আমাদের অফিসে আসেন সরাসরি কথা হবে। গতবছরের শুরুর দিতে ফরএভারে জয়েন করেন আকাশ মাহমুদ নামের একজন গ্রাহক। তিনি জনকণ্ঠকে জানালেন, একজন বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তিনি ২৫ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে পণ্য কেনেন। এরপর আর কাউকে তিনি সদস্য করাতে পারেননি। জানালেন কোম্পানির পণ্য বলতে প্রসাধনী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ। এত দাম দিয়ে এই পণ্য কেউ কিনতে চায় না। আমাদের দেশের পণ্যের তুলনায় ৭-৮ গুণ মূল্য ধরা হয়েছে। আকাশের কাছে কোম্পানির ‘এলো ভেরা জেল’, ‘এলো হ্যান্ড সোপ’, ‘এলো লোশন’ সংগ্রহ করে দেখা গেল, পণ্যের গায়ে ফরএভার লিভিং পোডাক্টস বাংলাদেশ নামে আমদানি করা বিএসটিআই’র স্টিকার। ওজনে একই পণ্য বাংলাদেশে যেখানে ২০০-২৫০ টাকা সেখানে ফরএভারের পণ্যের গায়ে লেখা ১৭০০ টাকা। এভাবে উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে ‘কম্বো প্যাক’ বানিয়ে প্রতারণা করছে কোম্পানিটি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কোম্পানিটি তো কয়েক ধরনের প্রতারণা করছে। উচ্চমূল্য নির্ধারণ করে এক ধরনের প্রতারণা। পণ্যের গুণগতমান নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই। এখনি এই কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করা না গেলে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাবে। পাশাপাশি দেশের যুবক-যুবতীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, ডেসটিনি-২০০০ নামের কোম্পানিটির উর্ধতন কর্মকর্তারা একযুগে (২০০০-২০১২) প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাত করেন ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। সেইসঙ্গে শতকোটি টাকার ওপরে বিদেশে পাচার করেন। এ বিষয়ে অর্থ আত্মসাত ও মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে ডেসটিনির ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণয়ন করা হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন। এই আইনের অধীনে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা হয় বিধিমালা, যা আবার সংশোধন করা হয় ওই বছরেরই ২২ জুলাই। আইনে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আর লাইসেন্স দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা করা হয় যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়কে (আরজেএসসি)। আইনে বলা হয়, পিরামিডসদৃশ বিপণন কার্যক্রম চালানো, সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য বা সেবা বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সূত্র জানায়, আইন হওয়ার পর ২০১৪ সালে ‘এমএক্সএন মডার্ন হারবাল ফুড’, ‘ওয়ার্ল্ড মিশন ২১’, ‘স্বাধীন অনলাইন পাবলিক লিমিটেড’ ও ‘রিচ বিজনেস সিস্টেম’ নামে চারটি এমএলএম কোম্পানিকে অনুমোদন দেয় আরজেএসসি। যার মেয়াদ ২০১৫ সালের ৪ মার্চ শেষ হয়েছে। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ থাকায় এই কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স আর নবায়ন করেনি আরজেএসসি। সেইসঙ্গে বন্ধ করে দেয়া হয় এমএলএম কোম্পানির নিবন্ধন। আর ফরএভার লিভিং প্রডাক্টস বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৪ সালে এমএলএম ব্যবসার অনুমোদন চেয়ে আবেদন করলেও আরজেএসসি থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে অনুমোদন দেয়া হয়নি।
×