ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মানব পাচার বন্ধে সরকারের নানা উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১০:২৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 মানব পাচার বন্ধে সরকারের নানা উদ্যোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানব পাচার বন্ধের জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ‘পালেরমো প্রোটোকল’ অনুসমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এই প্রোটোকলের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া হবে। মানব পাচারকারী যেই হোক তাকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। রবিবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত ‘কম্প্রিহেন্সিভ রেস্পন্সেস টু ট্রাফিকিং ইন পারসন্স’ শীর্ষক কর্মশালায় পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহিদুল হক এ কথা বলেন। জাতিসংঘের মাইগ্রেশন নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বাংলাদেশ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টপেন্টের ব্যুরো অব ইন্টারন্যাশনাল নারকোটিক্স এ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট আফেয়ার্স (আইএনএল)। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে কর্মশালায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সিলর ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন উপস্থিত ছিলেন। আইনগতভাবে কার্যকর যোগ্য এই প্রটোকলের অনুসমর্থনের নথি জাতিসংঘে পাঠানো হয়েছে। মানবপাচার নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের আয়োজিত কর্মশালার উদ্বোধনের সময় শহিদুল বলেন, দেখবেন হঠাৎ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এটি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেয়ার পটভূমিতে পররাষ্ট্র সচিব এমন মন্তব্য করেন। বলপূর্বক শ্রম, সেবা ও যৌনকর্মে বাধ্য করা এবং অভিবাসী পাচার বৈশ্বিক সমস্যা। এগুলো বাংলাদেশের জন্যও ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার পাচারের তথ্য গোপন করায় এ বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। কর্মশালয়ায় অবৈধভাবে দেশের বাইরে যাওয়ায় বাংলাদেশের অনেক অভিবাসী মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছেন। চলাচলে সীমাবদ্ধতা, ঋণের চক্রে পরা, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নির্যাতন, জোরপূর্বক বিবাহ এবং দাসত্বের মতো শোষণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন অভিবাসীরা। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারী ও পুরুষ এবং শিশুরাই মানবপাচারকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন। সকল স্তরে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ, বেসরকারী খাত এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক অংশীদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানবপাচারের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মানবপাচার এবং চোরাচালান উভয়ই বৈশ্বিক ঘটনা। এটি বাংলাদেশের জন্য এখন হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ট্রাফিকিং ইন পার্সন (টিআইপি) রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ অবৈধভাবে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। এই অভিবাসীরা পাচারকারীদের শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ করাণে টিআইপি প্রতিবেদনে টানা তিন বছর বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘ওয়াচ লিস্টে’ রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার মানবপাচার নির্মূলে যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছে না। মানবপাচার প্রতিরোধে সরকার ও অভিবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সকল পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ আসে প্রতিবেদনে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পলিটিক্যাল-ইকনোমিক কাউন্সেলর ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন বলেন, মানাবপাচারকে আমরা মারাত্মক অপরাধ হিসেবে দেখছি। সর্বশেষ টিআইপি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় পর্যায়ের লিস্টে আছে, যেটি উদ্বেগের বিষয়। কারণ, পাচারের শিকার অনেক মানুষ এখন ভুক্তভোগী। এই প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হলো, ‘পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের গঠনমূলক কর্মপরিকল্পনা আছে। এখন এর প্রয়োগের উপর জোর দিতে হবে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে জাতিসংঘের রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটর, মিয়া সেপ্পো বলেন, সমাজে যারা প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত এবং ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন তারাই বেশি পাচারের শিকার হচ্ছেন। এই সমস্যা সমাধানে সমন্বয়, সক্ষমতা বৃদ্ধি, সম্পদ ও পরিসংখ্যান অনেক জরুরী। তবে এই বিষয়গুলো বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। মানবপাচার প্রতিরোধে সৃজনশীল এবং সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি একটি উন্নয়নমূলক বিষয়। যারা পাচারের শিকার হচ্ছেন বা বেঁচে আসতে পারছেন তাদের অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে। ধারণাপত্রে বলা হয়, পাচারের শিকার মানুষ যৌন শোষণ, জোরপূর্বক শ্রম, বহু ও জোরপূর্বক বিবাহ, শিশু কর্মীদের শোষণ, পথশিশুদের পাচার এবং অঙ্গবাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিবাসী কর্মীরা অনৈতিক নিয়োগের শিকার হচ্ছেন। পাচারকারীরা ভারত, পাকিস্তান ও এশিয়ার মধ্যপূর্বঞ্চলীয় দেশগুলোর ব্যবহার করে মানুষ নিয়ে যাচ্ছে। এতে মানুষ ভয়বহ অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছেন। যেটি চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন। মানবপাচার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম বাংলাদেশের মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, কর্মসংস্থানের অভাব, নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে সচেতনতার অভাব এবং অভিবাসনের জন্য অনেক বেশি খরচের কারণে মানুষ অনিরাপদভাবে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। জাতিসংঘের মাইগ্রেশন নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক হিসেবে আমরা অভিবাসীরা যে দেশে থাকছেন, যে দেশ থেকে যাচ্ছেন এবং যে দেশগুলো দিয়ে যাচ্ছেন সেখানে তাদের অধিকার ও ভাল থাকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। একই সঙ্গে মানবপাচার রোধে আমরা সব সময় সরকারের পাশে আছি। মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১২ সালের মানাবপাচার প্রতিরোধ আইন অন্যতম। ২০১৭ সালের ওই আইনের বিধি করে বাস্তবায়ন করছে সরকার। এছাড়া মানবপাচার রোধে সরকার ২০১৮-২২ ব্যাপী একটি জাতীয় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, মানবপাচার বিশ্বব্যাপী তৃতীয় বৃহত্তর ব্যবসা। মানবপাচার প্রতিরোধে এর মধ্যে সরকার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। মানবপাচার বিষয়টি যেভাবে বড় হচ্ছে সেই হারে আমদের মানবসম্পদ নেই। তবে সব পক্ষ একসঙ্গে কাজ করলে আমরা মানবপাচার প্রতিরোধ করতে পারব।
×