ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘মঞ্চশিল্পী’ হিসেবে তরুণদের ভাবনা

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

‘মঞ্চশিল্পী’ হিসেবে তরুণদের ভাবনা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ থিয়েটার কর্মীদের মঞ্চশিল্পী হিসেবে আখ্যা দেয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কতিপয় মানুষ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে চেয়েছেন থিয়েটার কর্মীরা আসলে শিল্পী নয়। তারা সেটা হতেও চায় না এবং আদৌ সেটার প্রয়োজন আছে কিনা। কিন্তু বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের এই সিদ্ধান্তে অনেকটাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন দেশের বেশিরভাগ নাট্যকর্মী। বিশেষ করে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অনেকেই এই বিষয়টিতে পুলকিত বোধ করছেন তাদের অধিকার এবং সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে ‘মঞ্চশিল্পী’ সম্বোধন করায়। এ বিষয়ে তরুণ প্রজন্ম কি ভাবছেন যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন প্রতিক্রিয়া জানাননি। এমন কয়েকজন তরুণ মঞ্চশিল্পীর মন্তব্য নিয়ে এ প্রতিবেদন। সরণ সাহা (জাগরণী থিয়েটার) : মঞ্চকর্মী নাকি মঞ্চশিল্পী এই তর্কে আমি মঞ্চকর্মীর পক্ষে মত দিতে চাই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নিশ্চয় নতুন কোন ভাবনা আছে। যদি শুধু সম্মান দেখানোর জন্য মঞ্চশিল্পী উপাধি দেয়ার কথা ভাবা হয় তাহলে আমি এতে দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ বাস্তবতা হলো সম্মানের চেয়ে সম্মানী এখন বেশি প্রয়োজন। মনে হতে পারে এটি ক্ষোভের কথা, অভিমানের কথা। হয়তো তাই ঠিক। এটা এখন সময়ের দাবি। আমরা জানি মঞ্চ বন্ধুরা আমরাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। যারা সংগঠন পরিচালনা করে তারা জানে একজন মঞ্চকর্মী বা শিল্পী তৈরি করতে কত কষ্ট এবং তাকে কাজে ধরে রাখা আরও কষ্টের। কারণ অর্থনৈতিক সাপোর্ট ছাড়া একজন কর্মী কিভাবে নিজেকে বাঁচাবে? শুধু জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন কত প্রতিভা নষ্ট হচ্ছে তার খবর কে রাখে? এক্ষেত্রে অগ্রজগণের ভূমিকা কী? তাদের হাতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা এ বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ান না, কেন? আমার মতে একজনকে শিল্পী ঘোষণার পূর্বে তাকে আগে কর্মী হিসেবে তৈরি করে তার সম্মানীর ব্যবস্থা করে তারপর তাকে শিল্পীর সম্মান দেখানো দরকার। তা না হলে মঞ্চকর্মী আর মঞ্চশিল্পী এ দুয়ের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য আর থাকে না। এইচ আর অনিক (চন্দ্রকলা থিয়েটার) : পৃথিবীতে একমাত্র পেশা যেখানে অর্থ ফেরত আসবে না জেনেও ইনভেস্ট করি মঞ্চ নাটকে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সমাজের সকল সমস্যা বা রাষ্ট্রের বিপদ-আপদে মঞ্চ নাটকের মানুষরা এগিয়ে যায়। ক্রিকেটের পর বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে মেলে ধরে মঞ্চনাটক। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে অন্যকে বিনোদিত করে মঞ্চ নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীরা। নিজের বাবা মা, স্ত্রী, সন্তান ভাই-বোনের চাইতে মঞ্চনাটকে বেশি সময় দেয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। রোদ-বৃষ্টি ঝড়, তীব্র গরম অথবা শীত উপেক্ষা করে মঞ্চনাটকে অভিনয় করে। প্রায় দুপুরে একটা সিঙ্গাড়া খেয়ে সমস্ত শক্তি ব্যয় করে মঞ্চনাটকে অভিনয় করে অভিনেতা অভিনেত্রীরা। মঞ্চনাটকে অভিনয় করে বলে পরিবারের কাছে মাথা নিচু করে থাকতে হয় মঞ্চনাটকের মানুষদের। এত কিছুর পরও আমাদের নাট্যকর্মী আখ্যায়িত করে আমাদের পেশাকে সঙ্কুচিত করা হয়। আমাদের ছোট করে রাখার একটা প্রক্রিয়া হচ্ছে নাট্যকর্মী হিসেবে পরিচয় করানো। কোন ডাক্তারকে যদি মাঝি বলে ডাকা হয় আর কোন ইঞ্জিনিয়ারকে যদি মালী হিসেবে ডাকা হয় তাহলে তাদের অনুভূতি কেমন হবে। তেমনি মঞ্চনাটকের শিল্পীদের নাট্যকর্মী বলে সম্বোধন করলে খুব কষ্ট লাগে। মঞ্চনাটক এখনও আমরা পেশা হিসেবে নিতে পারছি না। কিন্তু আমরা আমাদের সম্মান চাই। আমাদের মঞ্চশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারের এই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। আমি এখন থেকে আমাকে মঞ্চশিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাই। জয় হোক মঞ্চশিল্পীদের। কনক কুমার পাল অলক (বগুড়া থিয়েটার) : একজন মানুষ যিনি শিল্পকে আঁকড়ে ধরে শিল্প সত্তাকে নিজ অস্তিত্বে লালন করেন, তিনি হয়ে ওঠেন শিল্পী। শিল্পকে আয়ত্ত করতে হয় সাধনার মাধ্যমে। তাই থিয়েটার তো অবশ্যই এক সাধনার বিষয় তাহলে থিয়েটারের একজন মানুষ শুধু কর্মী না তিনি একজন শিল্পীও বটে। শিল্প ভূমিতে বিচরণকারী অন্য মাধ্যমের মানুষ যেমন চারুকার, নৃত্য, সঙ্গীত, বাচিক, এমনকি যিনি ছোট বা বড় পর্দায় অভিনয় করেন তারা সকলেই শিল্পী পরিচয়ে পরিচিত হয়ে থাকেন, আবার যাত্রার মঞ্চে অভিনয়ের মানুষটিও যাত্রাশিল্পী তবে শুধু মোটা দাগে থিয়েটার করা মানুষটি শিল্পী হবে না কর্মী হবে এই প্রশ্নচিহ্ন কেন? যিনি কর্ম করেন তিনিই কর্মী। আর কে না জানে একজন থিয়েটারের কর্মীকে কত কাজের মধ্য দিয়ে থিয়েটারের সিঁড়ি ডিঙ্গাতে হয়। জুতা সেলাই থেকে চ ীপাঠ সব কাজই তো একজন থিয়েটার কর্মীকে করতে হয়। তাই কর্মী শব্দটি কোনভাবেই তুচ্ছার্থে বোঝানো হয় না একজন থিয়েটার কর্মীকে। যে কোন শিল্পপথের মানুষ শিল্পকর্ম করেই হয়ে ওঠেন শিল্পকর্মী। মঞ্চকর্মী বা মঞ্চশিল্পী যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন জয় হোক থিয়েটারের। কানিজ ফাতেমা (ঢাকা মৌলিক নাট্যদল) : শিল্পী হয়ে ওঠার জন্যই আমি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমি আমার সর্বোচ চেষ্টা দিয়ে সেটা করে যাচ্ছি আজীবন করে যাব। আমরা থিয়েটার চর্চা করিÑ সেটা কথা শিল্প হয়ে উঠলো সেটা বলবেন দর্শক। ভাল মন্দের বিচার করে বলবেন শিল্পী হিসেবে আমি কতটা সফল। তবে আমি নিজেকে শিল্পীই ভাবি। এ কারণেই অন্য শিল্পীকেও সম্মানের চোখে দেখি। যে কোন বিষয় সততা, নিষ্ঠা এবং ভালবাসার সঙ্গে করলে সেটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে বাধ্য। সমাজ সেটাকে যদি গ্রহণ করে তবে শিল্পী সফল না করলে শিল্পী ব্যর্থ। তবে চর্চাকারী অবশ্যই শিল্পী। থিয়েটার কর্মী হিসেবে শিল্পী পরিচয়ে আমি গৌরবান্বিত বোধ করছি। আমাকে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে সম্মানটুকু দেয়ার জন্য বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনকে ধন্যবাদ জানাই। আমি বিশ্বাস করি আমার মতো যারা নিজের ঘরের খেয়ে বনে মোষ তাড়ান, তারা এই সম্বোধনে কিছুটা হলেও শান্তি পাবেন। যেমন আমি পুলকিত বোধ করছি একজন মঞ্চশিল্পী হিসেবে। ধন্যবাদ আমার দল প্রধানকে আমাকে শিল্পী হিসেবে তৈরি করার জন্য। থিয়েটারের মানুষগুলোর জয় হবেই এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
×