ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অতিরিক্ত ত্রাণ ও সুযোগ সুবিধা ছাড়তে নারাজ রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ৩১ আগস্ট ২০১৯

 অতিরিক্ত ত্রাণ ও সুযোগ সুবিধা ছাড়তে নারাজ রোহিঙ্গারা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ রোহিঙ্গাদের অতিরিক্ত ত্রাণ প্রদানসহ মন জয় করে আশ্রয় শিবিরে স্থায়ী করে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে কয়েকটি এনজিও। সরকারের নির্দেশনা তথা এনজিওব্যুরোর নিয়ম লঙ্ঘন করেছে তারা। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুয়ায়ী রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা না দেয়ার নিষেধ রয়েছে সরকারের। ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী একশ্রেণীর কর্মকর্তার খামখেয়ালি ও এনজিওদের কাছ থেকে উপঢৌকন পাচ্ছে বলে তারা দেখেও দেখে না। অতি উৎসাহী কিছু এনজিও আশ্রয় শিবিরে প্রতিটি স্কুলে বাংলা পাঠ্যবই শিক্ষা দিচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুদের। সরকারের অজান্তে নগদ টাকাও বিলি করছে অনেকে। রোহিঙ্গাদের চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দেয়া হচ্ছে নিয়মিত। এর বাইরে কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের হাতে টোকেন ধরিয়ে দিয়ে ক্যাম্প এলাকায় দোকান ঠিক করে দিয়েছে। রোহিঙ্গারা ওই টোকেন নিয়ে দোকানে গেলে তাদের চাওয়া মাত্রই সব পণ্য দেয়া হচ্ছে। মাস শেষে ওসব পণ্যের মূল্য প্রদান করছে একাধিক এনজিও। রোহিঙ্গাদের বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে বলেই তারা সহজে মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে না বলে মত প্রকাশ করেছে অভিজ্ঞ মহল। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের একদিন না একদিন ফিরে যেতে হবে নিজেদের দেশে। এনজিওগুলো যতই জামাই আদরে রাখার চেষ্টা করুক না কেন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা পর্যায়ক্রমে ফিরে যাবেই মিয়ানমারে। তারপরও রোহিঙ্গাদের মন জয় করে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে রাখার পরিকল্পনার অংশবিশেষ বাংলা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের। তাদের বিদেশে নিয়ে যাবার লোভ দেখানো হয়েছে। একদিকে অতিরিক্ত ত্রাণ প্রদান অপরদিকে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের বিদেশে নিয়ে যাবার লোভে রোহিঙ্গারা অনীহা প্রকাশ করছে নিজ দেশে ফিরতে। বর্তমানে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট করাতে গিয়ে আঙ্গুলের চাপজনিত কারণে ধরা খাচ্ছে। ওই রোহিঙ্গাকে ফের ফেরত পাঠানো হচ্ছে আশ্রয় শিবিরে। রোহিঙ্গাদের বোঝানো হয়েছে, শিশু-কিশোরদের নিবন্ধন করা হয়নি। তাদের আঙ্গুলের চাপও কোথাও নেই। পাসপোর্ট করা গেলে রোহিঙ্গা ভাষা ছাড়াও তারা বাংলা লেখা এবং শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারবে। লিখতে পারবে শিখিয়ে দেয়া বাপ-দাদার ঠিকানা। তাই তারা সহজে পাসপোর্ট পাবে। পাড়ি দিতে পারবে বিদেশে। পরবর্তীতে এদেশের নাগরিক বলে দাবি করবে রোহিঙ্গারা। কুতুপালং শিবিরের রশিদুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা অভিভাবক জানায়, আমরা আগ্রহ করে স্কুলগুলোতে বাংলা পাঠ্যবই শেখাতে বলেছি। সূত্র আরও জানায়, রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের বাংলা বই শিক্ষা দেয়ার ঘটনা এটা নতুন কিছুই নয়। বিএনপি খালেদা জিয়ার (জামায়াত ঐক্যজোট) আমলে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা পাঠ্যবই শিক্ষা দেয়া নিষেধ ছিল না। ১৯৯২সালে অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গা শিশুরা বাংলা শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন করছে। নিজেদের বাংলাদেশী দাবি করে ভোটার তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে অনেকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিভিন্নস্থানে সরকারী-বেসরকারী চাকরিও করছে। তারা পাসপোর্টও বানিয়েছে। বাংলাদেশী দাবিী করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশী সেজে পড়ালেখা শেষ করেছে অনেকে। ওই আরএসও জঙ্গীদের অবস্থা দেখে আশ্রয় ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের বাংলা পাঠ্যবই শিক্ষা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তাদের রোহিঙ্গা পিতামাতা। সচেতন মহল বলে, আশ্রয় ক্যাম্পে চাল, ডাল পাবার স্থলে প্রসাধনী দ্রব্যাদি পর্যন্ত পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এমনকি অনেক সময় নগদ টাকাও পাচ্ছে। এজন্যই রোহিঙ্গারা এত সুখ-শান্তি ফেলে মিয়ানমারে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে না। রোহিঙ্গারা যখন মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছিল তখন তারা ছিল আশ্রয় প্রার্থী। প্রত্যাশী ছিল একমুঠো ভাতের। ওই সময় তাদের কেউ কেউ ছিল ৫-৭ দিনের ক্ষুধার্ত। অনেকে ছিল অসুস্থ। এই অবস্থায় মানবিক কাজে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনগণ। তারা তাদের সাধ্যানুযায়ী রান্না করা খাবার, কাপড়, ওষুধ ও নগদ টাকা ইত্যাদি দিয়ে রোহিঙ্গাদের এহেন দুরবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়ায়। সরকার বনভূমিতে (৬ হাজার একর) প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়। সেখানে তারা ২বছর ধরে বসবাস করছে। গত দুই বছর ধরে আশ্রয় ক্যাম্পে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে রোহিঙ্গারা আগের মতো ক্ষুধার্থ নেই। তারা বর্তমানে সুঠামদেহের অধিকারী। সরকারের প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। দুবার সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য; কিছু ষড়যন্ত্রকারীর কারণে এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। আবাসন ব্যবস্থা ॥ রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য প্রতিটা পরিবারের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা থাকার ঘর। অধিকাংশ ঘর ত্রিপলের চাউনি, ত্রিপলের বেড়া ও মেঝে অধিকাংশ পাকা করানো। যদিও কোন কোন ক্যাম্পে দাতা সংস্থার ডিজাইন অনুযায়ী ছনের চাউনির ঘরও বিতরণ হয়েছে। পরিবারের সদস্য সংখ্যানুপাতে ব্যবস্থা করা হয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার। সকলের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে সুপেয় নিরাপদ পানির। রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য ও বিবিধ পণ্য ॥ পরিবারের সদস্য অনুপাতে মাসিক চাহিদা নিরূপণ করে বিতরণ করা হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী। খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, তেল, লবণ, মসলা, ডিম, আলুসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি নিয়মিত দেয়া হয় সাবান, শ্যাম্পু, সেনিটারি ন্যাপকিন, টুথপেস্ট, বালতি, গ্যাস-চুলা, প্রতিমাসে গ্যাস সরবরাহ, কম্বল, টাওয়েল, আয়না, চিরুনি, নারিকেল তেল, হাঁড়ি, পাতিল, মশারি, নগদ টাকা, হুইল পাউডারসহ নানাবিধ পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী। চিকিৎসা ব্যবস্থা ॥ রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়ার জন্য রয়েছে বিভিন্ন সুবিধা সংবলিত স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র। পাশাপাশি বাড়ি পর্যায়ে অসুস্থ ও অপুষ্ট রোগী শনাক্তকরণের জন্য রয়েছে আলাদা আউটরিচ কর্মী বাহিনী। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে উন্নত চিকিৎসাসেবাও নিশ্চিত করা হয়েছে সমগ্র ক্যাম্প এলাকায়। কোন কোন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা, ৭ দিন। এসব হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন দেশী-বিদেশী অভিজ্ঞ চিকিৎসাগণ। নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে মা ও শিশু হাসপাতাল। পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে আলাদা পুষ্টিসেবা কেন্দ্র। প্রতিটা চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে রয়েছে মানসিক ও মনো-সামাজিক সাপোর্ট কেন্দ্র। জটিল ও মারাত্মক রোগীদের জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করার জন্য রয়েছে সর্বক্ষণিক এ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ॥ রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যক লার্নিং সেন্টার। এসব লার্নিং সেন্টারে নিয়োগ করা হয়েছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক-শিক্ষিকা। রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রায় প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে রয়েছে পর্যাপ্ত খেলনাসামগ্রী ও বিনোদনের ব্যবস্থা। পাঠদানরত শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত আয়োজন করা হয় বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের। ঝরে পড়া রোধ করার জন্য পরিচালিত হয় আউটরিচ কার্যাবলী। রোহিঙ্গাদের বস্ত্র ॥ জীর্ণ-শীর্ণ বসনের রোহিঙ্গা এখন আর চোখে পড়ে না। তাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকাপয়সা যোগ হওয়ায় তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী পরিধেয় ব্যবহার করছেন। ক্যাম্পের ভেতরেই মিলে বর্মার ঐতিহ্যবাহী থামি, লুঙ্গি ও কামিজের। রোহিঙ্গাদের আয় ইনকাম ॥ ধারণা করা হয় বর্তমানে প্রায় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারেই কোন কোন সদস্য নিয়মিত আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত। তাদের আয়ের বড় উৎস হলো দিনমজুরি, ক্যাম্পের ভেতরে আর বাইরে তাদের অধিকাংশ লোক দিনমজুরির কাজ করে দৈনিক ৪০০/৫০০ টাকা আয় করছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে গড়ে ওঠা হাজারও দোকানের মালিকানাও রোহিঙ্গাদের হাতে। সবজি, পান, মাছ, মাংস, কাপড়, স্বর্ণ, ওষুধ ও প্রসাধনী সব দোকানই রোহিঙ্গারা পরিচালনা করে থাকে। পাশাপাশি তাদের দেয় ত্রাণের কিছু অংশ তারা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে প্রতিমাসে আয় করে অনেক টাকা। রোহিঙ্গা নারী, পুরুষের অনেকে বিভিন্ন সেবা সংস্থায় কাজ করে ভাল বেতন অর্জন করছে। তাদের আয়ের বর্ধিত অংশ তারা স্বর্ণে বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে শত শত জুয়েলারি দোকান। কেবল বালুখালী পানবাজার থেকে বালুখালী ক্যাম্প পর্যন্ত স্থানে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক স্বর্ণের দোকান। অনেকে ঐ স্থানকে রোহিঙ্গাদের বলি বাজার (বর্মার প্রাচীন প্রসিদ্ধ বাজার) বলে আখ্যায়িত করে। কেউ কেউ ইতোমধ্যে তাদের অর্জিত টাকায় হাঁস,মুরগি ও পশুপালনের মতো কাজের দিকেও ঝুঁকছে। গত দু’বছরে (২০১৭-২০১৯) রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক যে অগ্রগতি হয়েছে, তা তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে বিগত দু’শ’ বছরেও হয়নি বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। অভিজ্ঞজনরা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এসব সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে ওই রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে রাজি হবে না। প্রত্যাবাসন ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করার জন্য দেশের সকল মহলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা রাখার উপযুক্ত সময় চলে আসছে। নচেৎ এই রোহিঙ্গা ইস্যু শীঘ্রই বাংলাদেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
×