ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চুনোপুঁটিতেও রুই কাতলা ধরার আনন্দ

প্রকাশিত: ১১:১০, ৩১ জুলাই ২০১৯

চুনোপুঁটিতেও রুই কাতলা ধরার আনন্দ

মোরসালিন মিজান ॥ ক্রংকিটের শহর ঢাকা। নদী পুকুর জল জলাশয় কিছুই তেমন নেই। তাতে কী? এখানেই চলছে মৎস্য শিকার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিপ ফেলে বসে থাকা। বিশালাকার রুই কাতলার খোঁজ। কেউ সফল হচ্ছেন। শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছেন কেউ। তবুও মনে একটা আনন্দ। শৌখিন মৎস্য শিকারিদের এই আনন্দ দেখতে হলে রমনাপার্কে ঢুঁ মারা চাই। হ্যাঁ, রমনার লেকটি ঘিরেই এখন মৎস্য শিকারিদের বড় সমাবেশ। এটি যেন বিস্মৃত প্রায় গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী। বাড়ির সামনের পুকুর। ছেলে বুড়ো সকলেই এখানে মাছ ধরায় ব্যস্ত। ধ্যান জ্ঞান সব এই এক কাজে দিয়ে রেখেছেন। দেখে মনে হয়, বড়শি হাতে সবাই চ-ীদাস! চুনোপুঁটিতেও রুই কাতলা ধরার আনন্দ! কী মাছ ধরা পড়ল? ওজন কত কেজি হবে? ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে ছুটে আসা লোকজনেরও অভাব নেই। সব মিলিয়ে অন্যরকম উত্তেজনা। রোমাঞ্চ। খুব চেনা রমনাপার্ক ঢাকার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। সাত দশকের পুরনো এই পার্কের পেটের ভেতরে ৬৮ দশমিক ৫ একর আয়তনের লেক। না, একেবারে ছোট বলা যাবে না। বদ্ধ পানিতে আছে বহু জাতের মাছ। তবে যে কেউ যখন তখন ধরতে পারে না। পার্ক ও লেকের কর্তৃপক্ষ গণপূর্ত অধিদফতর বছরে এক বা দু’বার মৎস্য শিকারের সুযোগ করে দেয়। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্ষাকালকে বেছে নেয়া হয়। এবারের মৌসুম শুরু হয়েছে গত ২১ জুন। এর পর থেকে চলমান আছে। তবে প্রতিদিন মাছ শিকার করা যাচ্ছেÑ এমন নয়। নিয়ম অনুযায়ী, সপ্তাহে মাত্র দুই দিন শুক্র ও শনিবার এ সুযোগ পাচ্ছেন মৎস্য শিকারিরা। তারও আগে ইচ্ছুকদের টিকেট সংগ্রহ করতে হচ্ছে। একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ শিকারের জন্য গুনতে হচ্ছে ৩০০০ টাকা। শিকারিরা প্রত্যেকে চারটি পর্যন্ত ছিপ ফেলতে পারছেন। কেউ কেউ বড়সড় মাছ ধরতে সক্ষম হচ্ছেন বৈকি। চুনোপুঁটি নিয়েও ঘরে ফিরতে হচ্ছে অনেককে। নিজ হাতে ধরা চুনোপুঁটিও শিকারির কাছে রুই কাতলা! গত শনিবার ছিল মাছ ধরার ষষ্ঠ দিন। এদিন দুপুরের দিকে রমনাপার্কে গিয়ে দেখা যায়, পুরোদমে চলছে মৎস্য শিকার। প্রায় অর্ধশত শিকারি। তাদের সঙ্গে এসেছেন এক্সপার্টরাও! কেউ ভাসমান চৌকিতে বসে ছিপ ফেলেছেন। কেউ লেকের জলে পা ভিজিয়ে মৎস্য শিকার করছেন। এ কাজে কী যে মনোযোগ তাদের! সত্যি দেখার মতো। রমনা চাইনিজ সংলগ্ন ছোট্ট গেট খুলে লেকের পাড়ে গিয়ে দেখা গেল এক অদ্ভুত নীরবতা। পানির উপর যতœ করে একটি চৌকি বসানো হয়েছে। ভাসমান চৌকিতে চেয়ার নিয়ে বসেছেন জনৈক শিকারি। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই বড় ছাতা দিয়ে মাথা ঢাকা। চোখ জলের দিকে স্থির হয়ে আছে। মাছ কখন টোপ গিলবে, সেদিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ তার। এরই এক ফাঁকে কথা হলো তার সঙ্গে। তাপস নামের এই শিকারি বললেন, আমি একটু নীরব জায়গা বেছে নিয়েছি। এ ধরনের জায়গা মাছ শিকারের বিশেষ উপযোগী। কেমন পাওয়া হলো? জানতে চাইলে বললেন, আসলে মাছ ধরা তো সাধনার ব্যাপার। ভাগ্য লাগে। আমি সকালে এসেছিলাম। এখন পর্যন্ত কয়েকটা ফলি মিরকা আর কালি বাউশ পেয়েছি। মাছ ধরা অনেক দিনের শখ জানিয়ে তিনি বলেন, লম্বা সময় ইউরোপে ছিলাম। সেখানেও মাছ ধরেছি। দেশে আসার পর নেশাটা আরও বেড়েছে বলা যায়। তাই রমনায় মাছ ধরা যাবে- এমন ঘোষণা শুনে দু’ দ- দেরি করিনি। এখানে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাছ আছে। কিন্তু টোপ গিলছে না। বাকি সময়ের মধ্যে গেলানোর সব চেষ্টা করবেন বলেও জানান তিনি। লেকপাড়ের জঙ্গল ঠেলে সামনে এগোতেই পাওয়া গেল আরেকজন শিকারিকে। নাম আব্দুল্লাহ। তার সঙ্গে আছে কয়েকজন সহকারীও। ঢালে বসে ছিপ ফেলেছিলেন তারা। কিন্তু কথা বলার সময় নেই কারও। মাছ ধরতে মরিয়া। এত তৎপরতা কেন? জানতে চাইলে এক পর্যায়ে মুখ খুলেন আব্দুল্লাহ। বলেন, ‘ভাই, মাছ লাগতাছে না। আমি ৩০ থেকে ৪০ কেজি ওজনের মাছও ধরছি। আজকে এখন পর্যন্ত বড় মাছের দেখা পাই নাই।’ পরের কথাটি আরও মজার। বললেন, ‘ইজ্জত ধরেন শ্যাষ!’ তার মানে, রাজধানীতে মাছ ধরার সঙ্গে ইজ্জত সম্মানের ব্যাপারটিও জড়িত! কবির নামের আরেক শিকারি দোষ দিলেন পানির। বললেন, পানি ঘোলা। বৃষ্টি হচ্ছে। তাই মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তেঁতুল গাছের নিচে বসে হতাশার কথা বলছিলেন রিমনও। বলতে বলতেই ঘটনাটা ঘটে গেল। টান পড়ল বড়শিতে। ওমনি হুইলের চাকা দ্রুত ঘোরাতে শুরু করলেন তিনি। মাছের সঙ্গে ছুটতে হলো কিছুক্ষণ। লেকের যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে মাছটাকে ডাঙায় তুললেন। মাঝারি আকারের কাতল। কী যে লাফালাফি করছিল! রমনার ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে যাওয়া লোকজনও এই সাফল্য দেখতে ছুটে এলেন। এক পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন এই দলে। নাম আজিম। বললেন, গ্রামে ছোট বেলায় কত মাছ ধরেছি! সেই স্মৃতি আজ যেন মনে পড়ে গেল। ইউনিফর্ম পরে এসেছেন। তা না হলে ছিপ নিয়ে বসে যেতেন বলে জানান তিনি। কোন কোন ছিপ ঘিরে বাড়তি ভিড়। তেমন একটি ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল সকলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মূল শিকারী মইনুল হোসেন। জানালেন, তিনি শিল্পকলা ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। হলের ছোট ভাইদের সঙ্গে নিয়ে মাছ ধরতে এসেছেন। জুনিয়রদের একটি অংশ ডাঙায় বসে মাছের টোপ তৈরি করছিল। এটিও দেখার মতো। অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি খাবারে মধু ঘি ইত্যাদি ঢেলে দেয়া হচ্ছিল। আরেকটি অংশ টোপ সাজাতে ব্যস্ত। ৮ বড়শি একত্রিত করে একটি টোপ তৈরি করা হচ্ছিল, দেখে পিলে চমকে যায়! একবার এটি মুখে নিলে মাছ ডাঙায় ওঠে আসতে বাধ্য। কিন্তু লোক তো অনেক। এত লোকের খাওয়ার মতো মাছ কি পাওয়া যাবে এখান থেকে? জানতে চাইলে মইনুলের উত্তরÑ ঢাকায় জীবন্ত মাছ দেখাই যায় না। সেখানে নিজ হাতে মাছ শিকার করছি। এটাই আমাদের অনেক পাওয়া। স্বামী স্ত্রী দু’জনে মিলে মাছ শিকার করছেনÑ এমন দৃশ্যও দেখা গেল রমনা লেকে। স্বামীটির নাম হুমায়ূন। গণমাধ্যম কর্মী। বললেন, মাছ ধরার জন্য ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। তার পাশেই স্ত্রী মৌ। বললেন, আমিও জব করি। সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখি ও বাসায় নেই। পরে ফোন করে জানলাম, রমনায় মাছ ধরতে এসেছে। আমিও ছুঁতো দেখিয়ে অফিস থেকে চলে এসেছি। তার মানে, মৎস্য শিকার পছন্দ করেন আপনিও? জানতে চাইলে মজার উত্তর দিলেন তিনি। বললেন, মাছ নয়। স্বামীকে পছন্দ করি। ও এসেছে তাই ওর জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছি। তবে আসার পর নিজেরও ভাল লাগছে বলে জানান তিনি। তবে বড় মাছ ধরার সাফল্যের কথা শোনা গেল হাতে গোন কয়েকজনের মুখে। তাদের একজন রাজিব। বললেন, ২০ থেকে ৩০ কেজি ওজনের দু’টি কাতল পেয়েছি আমি। বড় তেলাপিয়াও ওঠেছে। কীভাবে সম্ভব হলো? গোপন টোটকা আছে কোন? জানতে চাইলে তিনি বললেন, চ-ীদাস ১২ বছর বড়শির ছিপ ফেলে বসে ছিলেন, জানেন তো? তার পর সফল হয়েছিলেন তিনি। মাছ ধরার সফল হতে হলে টেকনিক জানতে হবে, তার চেয়ে বেশি থাকতে হবে ধৈর্য। তপস্যা ছাড়া মৎস্য শিকার সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাছ ধরার অনুমতি মিলবে আরও দুই দিন। সামনের শুক্র ও শনিবার পর্যন্ত মাছ ধরা যাবে। তবে সময় বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে বলেও জানা গেছে। সুতরাং যারা পিছিয়ে ছিলেন তারা বড়শিসহ প্রস্তুত থাকুন। রাজধানী শহরে বসেই গ্রামের অভিজ্ঞতা নিন। স্মৃতিতে ফিরে যান।
×