ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলায় পাকিস্তানীদের দিন শেষ!

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ৩১ জুলাই ২০১৯

বাংলায় পাকিস্তানীদের দিন শেষ!

১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানির যোদ্ধারা কসবার উত্তরে পাকসেনাদের গোসাইস্থান ঘাঁটি আক্রমণ করে। ২-৩ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে পাকসেনাদের কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় ও অনেক সৈন্য হতাহত হয়। আক্রমণের প্রবল চাপে টিকতে না পেরে পাকসেনারা গোসাইস্থান পরিত্যাগ করে পেছনে পলায়ন করে। সকালে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানি চৌদ্দগ্রাম থেকে এবং আরেকটি কোম্পানি জগন্নাথ দীঘি থেকে ট্রাঙ্ক রোড হয়ে মুক্তিবাহিনীর নানকারা এ্যামবুশ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনারা এ্যামবুশ অবস্থানের কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে গুলি চালায়। এতে রাস্তার উত্তর ও দক্ষিণে মোট ২৬ জন পাকসৈন্য হতাহত হয়। শত্রুবাহিনী পাল্টা হামলা চালাতে চালাতে ওই এলাকা থেকে সরে যায়, তারা বেসামরিক লোকজনের সহায়তায় মৃতদেহ সরিয়ে ফেলে। এই আক্রমণে মোট ৩২ পাকসেনা নিহত হয়। সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান পরিত্যাগ করে হরিশ্বরদার হাটের কাছে নতুন অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী বাজিতপুর এ পাক ন্যাশনাল ব্যাংক শাখায় অভিযান চালিয়ে কর্তব্যরত কোষাধ্যক্ষ এবং রক্ষিকে হত্যা করে। জেড ফোর্সের মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীর ব্যাটালিয়ানের ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানি যথাক্রমে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের নেতৃত্বে ময়মনসিংহের জামালপুর জেলার পাকবাহিনীর বকশীগঞ্জ কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে পাক বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর ‘ডি’ কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজসহ ৬৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৬৫ জন যোদ্ধা আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর দুই কোম্পানিযোদ্ধা ব্রহ্মপুত্র নদীর পারে পাকবাহিনীর বাহাদুরাবাদ ঘাট অবস্থানের ওপর তুমুল আক্রমণ চালায়। এতে ১০০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে ২ মাইল ভেতরে একটি চরে অবস্থান নেয়। কৃষ্ণপুরের সুরমা গ্রামে মুক্তিফৌজ ২টি এ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে রাখে। এতে ৩ টনের একটি সৈন্য ভর্তি যান আক্রান্ত হয় ও ২০ জন নিহত হয়। শত্রুরা রাগে ক্ষোভে পাশর্^বর্তী এলাকার জনসাধারণের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। জাতিসংঘের মহাসচিব উ’তআন্টের কাছে প্রেরিত বার্তায় বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতর জানায়, দেশের জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে পাশ কাটিয়ে শরণার্থী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ লাখ ৩৩ হাজার ৪ জন। রাওয়ালপিন্ডিতে জনৈক সামরিক মুখপাত্র ঘোষণা করেন, পাকিস্তান সরকার শীঘ্রই বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের দেশদ্রোহিতামূলক কর্মকা-ের ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে। গেরিলা আক্রমণের আশঙ্কায় সামরিক বাহিনী ঢাকা শহর ও শহরতলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। মৌলভীবাজারে মিসিরুল্লাহ, এনামুল্লাহ, জালালউদ্দিন প্রমুখ স্থানীয় দালালরা একত্র হয়ে এলাকার ৯ জন করে সদস্য নিয়ে ৩টি সাব কমিটি গঠন করে। বাগান বাজারে মুক্তিফৌজের আক্রমণে অনেক রাজাকার নিহত হয়। ছাগলনাইয়াতে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ১০ পাকসেনা নিহত হয়। নৌকমান্ডো সাব লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহর তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয় ব্যাচের ন্যাভাল কমান্ডো ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাইকৃত প্রায় ২০০ ছাত্রকে আগরতলার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বিক্রুট করা হয়। ২০০ কমান্ডোও পশ্চিমবঙ্গের প্লেসি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। গেরিলা বাহিনী রাজধানী ঢাকার বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে দুবার। তারা ঘন ঘন ঢাকা থেকে অন্যান্য শহরে যাওয়া রেল লাইন কেটে দিচ্ছে। আমেরিকার ব্যাপক হস্তক্ষেপে থিউ শাসকরা দক্ষিণ ভিয়েতনামে যেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, দখলদার পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী বাংলায় একই পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই দুঃখজনক এবং ভয়ঙ্কর অবস্থা যে কাউকে দুটি সমস্যার মুখোমুখি করবে। কিভাবে বাংলায় ভয়াবহ এবং দুর্বিপাকের আশু সমাপ্তি টানা যায়। বাংলায় সন্ত্রাস নিরসনে পাক সরকারের ওপর কার্যত কোন চাপ নেই কারণ চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করার ঝুঁকি নিতে চায় না যেহেতু রাশিয়া ভারতের প্রধান বহিঃবন্ধু হয়ে উঠছে। ওয়াশিংটন এমন কোন কিছু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে যা জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের বিপক্ষে যায়, যিনি যুগান্তকারী চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। চীন স্বভাবতই পাকিস্তানে তাদের স্বার্থের পেছনে লেগে আছে এবং স্বাধীন বাংলার বিবাদের বিষয় কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সেটা সম্পর্কে সবাই সচেতন। এদিকে যে কোন মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবার যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ওই সব দেশের মধ্যকার বৈঠকের ফলাফল হিসেবে আমরা শুধু একটি দীর্ঘমেয়াদী নিষ্পত্তির ক্ষীণ আশা দেখতে পাচ্ছি। ভিয়েতনাম সমস্যা বিবেচনায় চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ এনলাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটা সমাবেশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এমন একটা সম্মেলন হয়ত বাংলা ও পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কিছুটা কাজ করতে পারে। দি ইকোনমিস্ট ’বাঙলায় পাকিস্তানীদের দিন শেষ হয়ে আসছে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করা হয়েছে। পাকিস্তান জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের সেখানে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। ভারত এই সপ্তাহে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা মনে করে সীমান্তের এদিকে পর্যবেক্ষক থাকা উচিত। কিন্তু শরণার্থীদের ফিরে আসার প্রধান বাধাটি পূর্ব পাকিস্তানে দৃঢ়ভাবে বজায় রয়েছে। যখন কেউ পূর্ব পাকিস্তানে ভ্রমণ করবে তখন তার কাছে সুস্পষ্ট হবে যেÑ তারা অত্যধিক শক্তি ব্যবহার করেছে। প্রদেশজুড়ে যে ক্ষতি করা হয়েছে তা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এবং এটির একটি অফিসিয়াল কাহিনী ছিল- সেটা হলো সৈন্যদের যখন গুলি করা হয়েছে শুধু তখনই তারা গুলি করেছে। সর্বাধিক আক্রান্ত হয়েছে বাজার এলাকা, যেখানে তারা সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতি ও অগ্নিকা- ঘটিয়েছে। প্রদেশের প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশের কুটির পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং বেশিরভাগ এলাকায় চারপাশে রাস্তা এবং ব্রিজগুলো থেকে মানব বসতি সাফ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি যে মাত্র আটজন সৈন্য, যাদের মধ্যে কোন কর্মকর্তা নেই- যাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে বাড়াবাড়ির জন্য। রিপোর্ট আছে যে, কমপক্ষে একজন ব্রিগেডিয়ার তার কমান্ড দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ যদি এই ধরনের শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে তাহলে এটা বিদেশী সাহায্য দাতা এবং উদ্বাস্তুদের সন্তুষ্ট করতে পারে। বেশিরভাগ শরণার্থী হিন্দু- মোট প্রায় ৭ মিলিয়নের প্রায় ৬ মিলিয়ন হিন্দু। রাষ্ট্রপতি আশ্বস্ত করেছেন, নতুন সংবিধান আগের তুলনায় আরও বেশি ইসলামী হবে; এবং এটা এখনও অস্পষ্ট যে সেনাবাহিনী কিভাবে এটা থামাবে। ২১ জুন-রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের দুই দিন পর- ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরকে গুঁড়িয়ে ফেলা হয় এবং দুর্বৃত্তরা আশপাশের গ্রামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত করে। যেগুলোর বেশিরভাগ ছিল হিন্দুদের। হিন্দু শরণার্থী এখনও পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে যাচ্ছে। যারা সীমান্তে সাক্ষাতকার দিয়েছে তারা বলে যে তারা চলে যাচ্ছে কারণ তাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে ভবিষ্যত পাকিস্তানে তারা কোন স্থান পাবে না। দুটি নতুন দল ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করেছে। এখন পর্যন্ত এই কমিটি সেনাবাহিনীকে আওয়ামী লীগের সদস্যদের এবং হিন্দুদের সম্পর্কে তথ্য দেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অনেক লোক পালিয়ে গেছে এবং বরাদ্দ কমিটি করা হয়েছে যারা এসব পতিত জমি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবে। অফিসিয়ালি এসব জমি থেকে প্রাপ্ত আয়ের অর্ধেক যাবে রিলিফ ফান্ডে এবং যার সম্পদ সে যদি ফিরে আসে তাহলে তাকে তার জমি বুঝিয়ে দেয়া হবে। যেহেতু ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম তাই বাস্তবে তা ঘটবে কি-না সন্দেহ আছে। ফিরে আসা শরণার্থীদের পক্ষে তাদের জমি আবার ফিরে পেতে কষ্ট হবে- কারণ, এগুলোর দায়িত্বে আছে বিহারী ও মুসলিমরা যারা এই মুহূর্তে বর্তমান সামরিক সরকারের লোক। শান্তি কমিটির অধীনে রাজাকাররা কাজ করে, এরা হোম গার্ড-টাইপ স্বেচ্ছাসেবক যাদের সামান্য মজুরি দেয়া হয়, যারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ব্যাপারে গুপ্তচরবৃত্তি করে পুলিশকে সহায়তা করে। বলা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস আছে তারা যদি রাজাকারে নাম লেখায় তাহলে তাদের কেস উঠিয়ে নেয়া হবে এবং তারা সঙ্গে অস্ত্র বহনের ন্যায্য অধিকার পাবে। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার, সুবিধাবাদী সহযোগীদের সমন্বয়ে একটি দল, যাদের মুক্তি ফৌজ গেরিলারা তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা তাদের একটি পর্যাপ্ত সংখ্যায় হত্যা করেছে। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ বেসামরিক সমর্থন বাড়ানোর জন্য তাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে জেনারেল রাও ফরমান আলী, যিনি পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন, তিনি সর্বজনীনভাবে স্বীকার করেছেন যে শান্তি কমিটিতে কিছু খারাপ মানুষ রয়েছে। মুক্তি ফৌজ দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ঢাকাতে ও অপারেশন করতে পারে এবং ইাতামধ্যেই যেসব বাঙালী সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চলবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং যতদিন মুক্তিবাহিনী কাজ চালাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত সরকার বাঙালী কাউকে প্রশাসনে দিতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু অঞ্চলে শেলিং হয়েছে এবং মুক্তিবাহিনী আটটি কারখানা উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওপর সামান্য চাপ দেখা যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সংবাদ ব্যাপকভাবে সেন্সর করা হয় এবং শুধু ভারতীয় সম্প্রচার থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানা যায় এবং যেহেতু অর্থনৈতিক সঙ্কোচন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বিজনেস লবি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে উপস্থাপিত হচ্ছে না। শুধু ভুট্টো অব্যাহত মার্শাল ল’ বিষয়ে মাঝে মাঝে অভিযোগ করে এবং এটি কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে তার নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার জন্য। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×