ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আটক ৬ বিদেশী রিমান্ডে

সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র এটিএম বুথ থেকে টাকা হ্যাক করছে

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ৪ জুন ২০১৯

 সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র  এটিএম বুথ থেকে টাকা হ্যাক করছে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে এটিএম বুথের সিস্টেম হ্যাকিং করে টাকা তোলার মামলায় গ্রেফতারকৃত ৬ বিদেশী নাগরিকের তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি পুলিশ। রিমান্ডকৃত বিদেশী নাগরিকরা হচ্ছে, দেনিস ভিতোমস্কি (২০), নাজারি ভজনোক (১৯), ভালেনতিন সোকোলোভস্কি (৩৭), সের্গেই উইক্রাইনেৎস (৩৩), শেভচুক আলেগ (৪৬) ও ভালোদিমির ত্রিশেনস্কি (৩৭)। আসামিরা সবাই ইউক্রেনের নাগরিক। সোমবার ডিবি পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম এই আদেশ দেন। এদিকে যেকোন বিদেশী নাগরিক এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) বুথে ঢুকলে তার ওপর নজরদারির পাশাপাশি সর্বোচ্চ সতর্ক (রেড এ্যালার্ট) থাকার জন্য এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এক প্রতিবেদনে আদালতকে জানিয়েছেন, সংঘবদ্ধ ডিজিটাল জালিয়াত চক্রের সদস্যরা খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটের সামনের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের সিস্টেম হ্যাক করেন। জালিয়াতির মাধ্যমে ওই বুথ থেকে টাকা তোলার সময় জনসাধারণের সহযোগিতায় দেনিস ভিতোমস্কিকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ভিতোমস্কিকে সঙ্গে নিয়ে হোটেল ওলিও ড্রিম হ্যাভেন থেকে বাকি পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, অটোমেটেড টেলার মেশিনের (এটিএম) বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য বিশেষ এক ধরনের কার্ড ব্যবহার করা হতো। ওই কার্ডের মাধ্যমে যেকোন পরিমাণ টাকা তুলতে কোন পিন নম্বর প্রয়োজন হয় না। এছাড়া কার্ডটি বুথে প্রবেশ করানোর সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিস্টেম নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষও বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই উধাও হয়ে যেত বিপুল টাকা। এই ছয় আসামি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্রের সদস্য। তারা ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা তোলার জন্য বাংলাদেশে আসেন। জালিয়াতির এই ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনের জন্য আসামিদের আটদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন জানায় ডিবি। রিমান্ড শুনানির সময় আইনজীবী এইচ এম মাসুম আদালতে হাজির ছিলেন। তিনি জানান, আসামিরা ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেননি। আদালত শুনানি শেষে প্রত্যেক আসামির তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জালিয়াতির মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার অভিযোগে রবিবার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ডেলিভারি চ্যানেলের হেড অব অলটারনেট মশিউর রহমান বাদী হয়ে খিলগাঁও থানায় মামলা করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই মামলা করা হয়। মামলার এজাহারে মশিউর বলেন, সংঘবদ্ধ ডিজিটাল জালিয়াত চক্রটি খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথসহ আমাদের অন্যান্য বুথ থেকে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের টাকা উত্তোলন করছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ব্যাংকটির বাড্ডা বুথের দুটি এটিএম বুথ থেকে দুই বিদেশী নাগরিক বিভিন্ন কার্ড ব্যবহার করে একাধিকবার টাকা উত্তোলন করেন। বুথ থেকে একজন বের হয়ে আবারও টাকা তোলেন। এ সময় বুথে নিরাপত্তাকর্মীরাও উপস্থিতি ছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, টাকা উত্তোলনের সময় মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করেছেন তারা। চোখে ছিল সানগ্লাস। মাথায় ছিল টুপি। অভিনব এ নতুন কৌশলে টাকা টুরির ঘটনা নতুন করে চিন্তার ছাপ ফেলেছে দেশের ব্যাংকারদের মধ্যে। কারণ, এর আগে যতবারই এটিএম থেকে টাকা চুরি হয়েছে, প্রতিবারই গ্রাহকের কার্ডের তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড তৈরি করেছিলেন জড়িত ব্যক্তিরা। প্রতিবারই গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এবারের ঘটনায় পুরো এটিএম বুথের নিয়ন্ত্রণ নেন জড়িত বিদেশীরা। কীভাবে তারা বুথ থেকে টাকা চুরি করলেন, তার কোন কূলকিনারা করতে পারেননি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও পুলিশ কর্মকর্তারা। এতে দেশের এটিএম সেবার নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, গত শনিবার সকালে বাড্ডার এটিএম বুথের টাকার হিসাব মেলানোর সময় তিন লাখ টাকা কম হয়। ওই এটিএমের দায়িত্বে ছিলেন ওরনেট গ্রুপের নিরাপত্তাকর্মী। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দুই বিদেশী কর্তৃক টাকা উত্তোলনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এরপর সব এটিএম বুথে নিরাপত্তা বাড়ায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। শনিবার রাতেই খিলগাঁওয়ের তালতলা এলাকায় ডাচ্-বাংলার এটিএমে টাকা চুরি করতে গেলে দুই বিদেশীর একজন ধরা পড়েন। পরে আরও পাঁচ বিদেশীকে আটক করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় ৫০টি কার্ড ও মুখোশ, মাস্ক, মোবাইল ফোন সেট ও আইপ্যাড উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (পূর্ব) খিলগাঁও অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহিদুর রহমান জানান, তাদের কাছে যে কার্ডগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো এটিএম বুথে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাংকের কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে ওই বুথের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর তারা নিজেদের মতো করে টাকা তুলে নিয়ে যান। এটি সম্পূর্ণ নতুন ও অভিনব পদ্ধতি। আগে কখনও এই পদ্ধতির ব্যবহার তাদের নজরে আসেনি। অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহিদুর রহমান জানান, একজন এখনও পলাতক রয়েছেন। তিনি যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সেজন্য ইমিগ্রেশনে তথ্য দেয়া হয়েছে। আশা করছি শীঘ্রই পলাতক ওই সদস্যকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। বিদেশী নাগরিকদের ক্ষেত্রে এটিএম বুথগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার ॥ যেকোন বিদেশী নাগরিক এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) বুথে ঢুকলে তার ওপর নজর রাখার পাশাপাশি সর্বোচ্চ সতর্ক (রেড এ্যালার্ট) থাকার জন্য এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সতর্কতা জারির পর ব্যাংকগুলো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী জানান, আমরা ভয়ে আছি বিদেশীদের নিয়ে। যারা কিনা আমাদের এটিএম বুথে ঢুকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ কারণে আমরা সবাই এখন এটিএম বুথে বিদেশীদের লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছি। যেকোন বিদেশী নাগরিক এটিএম বুথে ঢুকলে তার ওপর নজর রাখার জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর আগে ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ঈদ-উল- ফিতরের ছুটিতে ব্যাংকের সব ব্যবসা কেন্দ্রসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সাইবার নিরাপত্তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বৃহস্পতিবার (৩০ মে) এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম জানান, ঈদের সময় ব্যাংক বন্ধ থাকে। এই বন্ধের সময় যাতে দুষ্টচক্র কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটায় সেজন্য ব্যাংকগুলোকে সাইবার নিরাপত্তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিদের্শনায় বলা হয়েছে, ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে ঘোষিত ছুটির দিনে ব্যাংকের সব ব্যবসা কেন্দ্রসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সাইবার নিরাপত্তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আপনাদের বিশেষভাবে নির্দেশনা দেয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ছুটির দিনসহ ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর রাতে হঠাৎ করে কর্মকর্তাদের শাখা পরিদর্শন করার ব্যবস্থা করতে হবে। ছুটির দিনগুলোতে ব্যাংকের আইটি সিস্টেম, বিভিন্ন স্থাপনা ও ভল্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পালাক্রমে তদারকির ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া ব্যাংকের সব ব্যবসা কেন্দ্রসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছাকাছি থানা অর্থাৎ পুলিশ স্টেশন, র‌্যাব অফিস ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশন যুগে প্রবেশ করায় অন্যান্য প্রযুক্তির পাশাপাশি আইসিটি প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির এ ধারায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে জটিল আকার ধারণ করছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আইটি সম্পৃক্ত ঝুঁকি আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূভাবে মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন যথাযথভাবে মেনে চলতে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশের অর্ধেক ব্যাংক এখনও সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। মোট ব্যাংকের ৫০ ভাগ সাইবার নিরাপত্তায় নেক্সট জেনারেশন ফায়ারওয়্যাল (এনজিএফডব্লিউ) সফটওয়্যার স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। বাকি ৫০ শতাংশের মধ্যে ৩৫ শতাংশ ব্যাংকে আংশিক এবং ১৫ শতাংশ ব্যাংকে এটি স্থাপন অনুমোদন পর্যায়ে রয়েছে। ফলে এই ৫০ শতাংশ ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা জারির মধ্যেই একটি বিদেশী চক্র ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে অভিনব প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে। এই চক্র এটিএম বুথ থেকে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যদিও ব্যাংকের সার্ভারে কোনও তথ্য যায়নি। এই ঘটনায় ছয় বিদেশী নাগরিককে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আটকরা সবাই ইউক্রেনের নাগরিক। ব্যাংক কর্মকর্তারা এভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাকে সাইবার ক্রাইম বলছেন। বেসরকারী ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাইবার অপরাধীরা বিভিন্ন ধরনের ছুটির সময়কে বেছে নেয়। তারা সব সময়ই অভিনব প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা চুরি করার চেষ্টা করে।
×