ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাঠিখেলা, লোকগান ও নত্যৃ পরিবেশনা

চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন

প্রকাশিত: ১০:২৬, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

  চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো/একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো ...। সেই আলোর পথরেখায় বিদায় নিলো আরেকটি বছর। সম্ভাবনাময় আগামীর প্রত্যাশায় সময়ের স্রোতধারায় বিলীন হলো বঙ্গাব্দ ১৪২৫। শনিবার ছিল বিদায়ী বাংলা বছরের শেষদিন ত্রিশে চৈত্র। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা সংস্কৃতির রীতিমাফিক চৈত্রসংক্রান্তি। এক সময়ের গ্রামীণ লোকাচারটি এখন মিশে গেছে নাগরিক জীবনে। তাই তো শহর ঢাকায় বসন্তের শেষ দিনটি হয়ে উঠল বর্ণময়। মঙ্গল ও কল্যাণের প্রত্যাশায় পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে স্বাগত জানানো হলো নতুন বছরকে। নাচ-গানের নানা পরিবেশনায় প্রকাশিত হলো সম্প্রীতির বারতা। গানের সুরে সুরে আলিঙ্গন করা হলো শিকড়কে। ছন্দোময় নৃত্যের তালে বছরের শেষ দিনটিতে ব্যক্ত হয়েছে অসুরবিনাশী দৃঢ় প্রত্যয়। এভাবেই মানবিকতার মর্মবাণীতে শান্তির প্রত্যাশায় ধাবিত হয়েছে নাগরিক মন। চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে নগরজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। শেকড়সন্ধানী শহরবাসী ঐতিহ্যের আবাহনে শামিল হয়েছে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপনের সেসব আয়োজনে। লাঠিয়ালের লাঠিখেলায় শিল্পকলার আঙিনা হয়ে উঠল একখ- গ্রাম বাংলা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উন্মুক্ত চত্বরে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে যৌথভাবে চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজন করে সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে চৈত্রসংক্রান্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্যের পসরায় সেজেছে কারুশিল্প মেলা। লোকজ বাংলা বছরের শেষ দিনকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বসেছিল লোকগানের আসর। সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত ময়দানে ছিল লাঠিখেলাসহ লোকগান ও নৃত্য পরিবেশনা। সুরের ধারার ‘লোক সুরে বাংলা গান’ ॥ রাজধানীর চৈত্রসংক্রান্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। যৌথভাবে বর্ষ বিদায়ের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সঙ্গীত সংগঠন সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত ১২টা অবধি পরিবেশিত হয়েছে লোকজ ধারার নানা আঙ্গিকের গান। ‘লোক সুরে বাংলা বাংলা’ অনুষ্ঠানটির নেতৃত্ব দেন সুরের ধারার চেয়ারম্যান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। বিচিত্র ধারার লোকগানে সাজানো ছিল এ আয়োজন। ছিল রবীন্দ্র, নজরুলসহ লোকজ ধারার পঞ্চকবির একগুচ্ছ গান। লোকজ বাংলার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পরিবেশিত হয়েছে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মারফতি গান। গান শুনিয়েছেন প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। চটকা আঙ্গিকের ভাওয়াইয়া গান গেয়েছেন নাদিরা বেগম। এছাড়াও অতিথি শিল্পী হিসেবে শ্রোতার হৃদয় রাঙিয়েছেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, ইয়াকুব আলী খান। সম্মেলক কণ্ঠে সুরের ধারার শিল্পীরা শুনিয়েছে রবীন্দ্রনাথের লোকজ আঙ্গিকের গান ‘এই বেলা ডাক পড়েছে’ ও ‘আপনাকে এই জানা আমার’। বৈচিত্র্যময় আয়োজনটিতে পরিবেশিত হয়েছে সিনেমায় ব্যবহৃত লোকগান। সেই সূত্রে পরিবেশিত হয়েছে বেদের মেয়ে ছবির গান ‘বাবু সালাম বারে বার’। শোনা গেছে শাহ আবদুল করিমের গান ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইলো/ কেমন দেখা যায়/ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও’। এছাড়া পরিবেশিত হয়েছে এই বাউলসাধকের ‘গাড়ি চলে না চলে না’ শীর্ষক সঙ্গীতটি। সম্মেলক কণ্ঠে ‘ফিরে চল মাটির টানে’ শিরোনামের সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে শেষ হয় চৈত্রসংক্রান্তির আনুষ্ঠানিকতা। আর এই গানের সঙ্গে ছিল মনমাতানো নৃত্য পরিবেশনা। সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচ করেন তামান্না রহমান, র‌্যাচেল প্রিয়াংকা প্যারিস ও মুনিরা পারভীন। সুরের ধারার শিল্পীরা পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের গান। সঙ্গে ছিল নৃত্য পরিবেশনা ও কবিতার শিল্পিত উচ্চারণের আবৃত্তি। চৈত্রসংক্রান্তি কথনে অংশ নেন সুরের ধারার চেয়ারম্যান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। মনমাতানো লাঠিখেলা পরিবেশনা ॥ দুপুর গড়ানো বৃষ্টিঝরা বিকেলে ঢাক-ঢোলের বোলে সরগরম হয়ে ওঠে শিল্পকলা একাডেমি আঙিনা। একাডেমির উন্মুক্ত স্থানে হওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ায় আয়োজনটি স্থানান্তরিত হয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনের সামনে। সংক্ষিপ্ত পরিসরের আয়োজনটিও হয়ে ওঠে মনোমুগ্ধকর। লাঠিখেলার মনমাতানো নানা কসরত প্রদর্শন করে নড়াইলের বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ লাঠিখেলা দল। লাঠিয়ালদের হাতের নৈপুণ্যে ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরতে থাকে লাঠি। প্রতিপক্ষকে আক্রমণের সঙ্গে উপস্থাপিত হয় আত্মরক্ষার নৈপুণ্যময় কৌশল। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চৈত্রসংক্রান্তি ॥ বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপন করেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঢাকা-ঢোলের বোলের সঙ্গে করতালের শব্দধ্বনি আমার বাঁশির সুরে উৎসবমুখরতায় শুরু হয় অনুষ্ঠান। সেই সুরের সঙ্গী হয়ে অতিথিরা প্রবেশ করেন মিলনায়তনে। এরপর সকলে মিলে অংশ নেন মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বালনে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। প্রদীপ প্রজ্বালন শেষে সবার মাঝে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া হয় মুড়ি-মুড়কি বিতরণের মাধমে। সরোদের স্নিগ্ধ সুর আর গল্পচ্ছলে সুরাশ্রিত পালাগানের পরিবেশনায় সাজানো হয় অনুষ্ঠান। সরোদ বাজিয়ে শোনান ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান। পালাগান পরিবেশন করেন সাইদুল বয়াতি। সেই সঙ্গে ছিল সরোদের কবিতায় সজ্জিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। উপস্থাপিত হয় শারীরিক কসরতের নয়নজুড়ানো এ্যাক্রেবেটিক। সব শেষে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে গানের সুরে স্বাগত জানানো নতুন বাংলা বছরকে। সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ‘এসো হে বৈশাখ’ শিরোনামের নববর্ষের আবাহনী সঙ্গীত। আল্পনায় রঙিন হলো রাজপথ ॥ বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে আল্পনার সখ্য দীর্ঘকালে। উৎসব-পাবর্ণে আল্পনা না হলে সেটা যেন ঠিক জমে ওঠে না। তবে বর্তমানে এ শিল্পটা কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়েছে পড়েছে। সেই ম্রিয়মাণ হতে যাওয়া লোকশিল্পকে আবারও সবার মাঝে তুলে ধরতে বার্জার পেইন্টস বিগত বছরগুলোতে আয়োজন করে আসছে আল্পনা উৎসব। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শনিবার চৈত্রসংক্রান্তির রাতে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে আয়োজন করা হয় ‘বার্জার আল্পনায় বৈশাখ ১৪২৬’। সপ্তমবারের মতো এ আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক এক্সপেরিয়েন্সিয়াল মার্কেটিং লিমিটেডের (ইএক্সপি) সহায়তায়। এবার ঢাকার বাইরে ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, বগুড়া, সিলেট ও খুলনাতেও এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মানিক মিয়া এভিনিউতে আয়োজিত মূল আয়োজনের উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। অতিথি হয়ে এসেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপি। জাদুঘরে লোকগান ও কারুশিল্প মেলা ॥ বিদায়ী শেষদিন শনিবার লোকসঙ্গীত অনুষ্ঠান ও কারুশিল্প মেলার আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর। স্েঙ্গ ছিল পিঠাপুলির পরিবেশনের আনন্দঘন আয়োজন। জাদুঘরের সামনের চত্বরে অস্থায়ী মঞ্চে লোকসঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে ভবনের দক্ষিণ প্রাঙ্গণে কারুশিল্প মেলার সূচনা হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান।
×