ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ৩০ মার্চ ২০১৯

  অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ কোন সামরিক অভিযান ছিল না; ছিল সাধারণ শোষিত মানুষের মুক্তির অকুতোভয় অসম সংগ্রাম। ধাপে ধাপে দখল হতে থাকা এই দেশকে মুক্ত করার প্রয়াসে এদেশের অগণিত নিষ্পেষিত প্রাণ চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের দুর্বার মুক্তিসংগ্রাম। কিন্ত ২৫ মার্চ থেকে চালানো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম-নৃশংসতার বিপরীতে সেগুলো ছিল অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিরোধ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিরোধ যুদ্ধগুলো হচ্ছিল সমন্বয়হীনভাবে আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। একাত্তরের এই দিনে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে রংপুর শহর ও সংলগ্ন গ্রামগঞ্জের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে বহু লোক প্রাণ হারায়। পাশাপাশি পাকিস্তানী বাহিনী আগুন জ্বালিয়ে বাড়িঘর-মহল্লা-গ্রাম ধ্বংস করে এবং পাশবিক অত্যাচার চালায়। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়া দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবারও ঘোষণা দেন যে, ‘পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনী বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত আক্রমণ শুরু করেছে এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে।’ তিনি তার ঘোষণায় বলেন, আমি এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ এবং আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য আবারও জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। সকাল ৮ টায় ১০৭ তম ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এসএআর দুররানী যশোর সেনানিবাসের অস্ত্রাগারের চাবি নিজের কাছে নিয়ে নেয়। বিকেল ৫ টার দিকে মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স দখল করেন। গোদাবাড়ীতে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীর ওপর পাকিস্তানী বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণে সিপাহী আবদুল মালেক শহীদ হন। ঢাকার পরে চট্টগ্রাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দুদিনের মধ্যেই পাকস্তানী বাহিনী প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এদিন ও এর পরের কয়েকদিন চট্টগ্রামের লালখানবাজারে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী ও বিহারী এবং রাজাকাররা মিলে হত্যা করে প্রায় আড়াই হাজার বাঙালীকে। এদিন ওয়াসার মোড়ের কল হতে পানি দেয়া হচ্ছে এমন প্রতারণামূলক গুজব রটিয়ে জড়ো করা হয় বাঙালীদের। এরপর হানাদার সেনারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে শত শত বাঙালীকে। বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারটি ধ্বংস করে দেয়া হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বীর শব্দসৈনিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে নিয়ে যায় মুক্তাঞ্চল রামগড়ে। সেখান থেকে আগরতলা। এই বেতার কেন্দ্রটির অনুষ্ঠানমালা মুক্তিযাদ্ধা এবং সব দেশপ্রেমিক মানুষের মধ্যে প্রবল আশা জাগিয়ে তুলেছিল। চট্টগ্রাম থেকে এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার এবং আবদুল্লাহ আল হারুন সীমান্ত দিয়ে আগরতলা পৌঁছান। আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের কাছে অস্ত্রশস্ত্রের সহায়তার আবেদন জানান। এদিন রাজশাহীর গোপালপুর রেলক্রসিংয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার সঙ্গে পাকবাহিনীর লড়াই ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা। এতে ৬টি ট্রাক, একটি জিপসহ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর সৈন্যদল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল পরিচালিত প্রতিরোধবাহিনী বেলুনিয়ার লড়াইয়ে ৪০ পাকসেনাকে বন্দী করে ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে। মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বাধীন বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পাকবাহিনী দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, ঝিনাইদহের পথে পালাতে থাকে। এ যুদ্ধে ২৫৬ পাকসেনা নিহত হয়। এদিন নাটোরের লালপুরে ‘ময়নার যুদ্ধে’ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে সাঁওতাল ও বাঙালীরা। এই সম্মুখযুদ্ধে সাঁওতাল তীরন্দাজসহ ৪০ বাঙালী শহীদ হন। মুক্তিপাগল জনতা, তৎকালীন ইপিআর ও আনসার বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হয় ২৫নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। ময়নার যুদ্ধের সময় তিনটি জেট বিমান আকাশে চক্কর দিতে থাকে। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আধিপত্য ভাঙ্গতে পাকিস্তানী জান্তা রিজার্ভ সৈন্যদেরও সবদিকে পাঠাতে শুরু করে। তবে প্রতিরোধের মুখে পড়ে সর্বত্র। বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ নতুন নতুন ফ্রন্টে পাকসেনা নিহত হয়। যশোরের খ-যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসে পাকসেনারাই উর্ধতনদের জানান মুক্তিসেনাদের বীরত্ব। ঢাকায় চোরাগুপ্তা হামলা করতে গিয়ে ধরা পড়ে দুই গেরিলা, ঢাকাতেও আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তল্লাশি শুরু করে । জীবন বাঁচাতে কয়েক লাখ শরণার্থীর পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার খবর শিরোনাম হয়ে ওঠে বিশ্বগণমাধ্যমে। এদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের মিছিল হয়। ভারতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠক ডাকেন ইন্দিরা গান্ধি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি লোক তাদের স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম শুরু করেছেন, ভারত তাতে সাহায্য না করে পারে না। ভারত তাই সংগ্রামে সাহায্য করেই যাবে।
×