ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পশ্চিমা ‘স্যাংশন’ ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে মাথাব্যথা

প্রকাশিত: ০৯:০০, ১ মার্চ ২০১৯

পশ্চিমা ‘স্যাংশন’ ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে মাথাব্যথা

পাঠক, নিশ্চয়ই ভাল করে মনে আছে- আমেরিকার ইরাক আক্রমণের কথা। যুদ্ধটি বন্ধ করতে ইউরোপসহ এশিয়ার প্রতিটি দেশের বড় বড় শহরে যুদ্ধবিরোধী মিছিল, সমাবেশ সংঘটিত হয়েছিল। ঢাকাতেও এমন কোন পেশাজীবী গোষ্ঠী দেখিনি যারা শহরজুড়ে মিছিল-সমাবেশ করেনি। পেন্টাগন বলেছিল ‘ইরাকে ডাব্লু এমডি অর্থাৎ উইপনস অব মাস্্ ডেস্ট্রাকশন’ রয়েছে, কেমিক্যাল অস্ত্র রয়েছে। যার জন্য ইরাককে শাস্তি দিতে ঐ যুদ্ধ।’ প্রকৃতপক্ষে ইরাকের এসব অস্ত্র ছিল না, বরং তেল বিক্রির অর্থ ডলারে না নিয়ে ইউরোতে নেয়ার, বিদেশের ব্যাংকে ইউরোতে রাখার সূচনা করতে গিয়ে সাদ্দাম হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল ক্রোধের শিকার হয়েছিলেন! যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্য পণ্য হচ্ছে ‘ডলার’। তাছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ইরাক, লিবিয়া ও ইরানের ওপর ‘স্যাংশন’ নামে যে সব মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে ঐসব দেশের লাখ লাখ শিশুর মৃত্যুর কারণ হয়েছে। তাকে সম্প্রতি ‘স্যাংশন অব মাস ডেস্ট্রাকশন’ নামে অভিহিত করে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ গারিকাই চেংগু বিশ্লেষণ করেছেন, যা প্রকৃত অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের আসল রূপকে উদঘাটন করেছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, গণতন্ত্রের জনক ও রক্ষকের দাবিদার ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলের নেতাকে বিস্ময়কর এবং অদৃষ্টপূর্ব কোনরকম গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছে! পাঠক, চিন্তা করুন যুক্তরাষ্ট্র খালেদাকে হঠাৎ একদিন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলে বিষয়টি আমাদের জনগণ তৎক্ষণাৎ যে প্রত্যাখ্যান করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ভেনেজুয়েলায় হুগো শ্যাভেজ সমাজতান্ত্রিক রীতিতে জনগণকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রদান করেন, খাদ্যের মূল্য, গৃহঋণ কমিয়ে সমাজে বৈষম্য কমালে যুক্তরাষ্ট্র যথারীতি ভেনেজুয়েলার ওপর স্যাংশন দেয়, সামরিক ক্যু দেতা’র চেষ্টা করে। প্রধানত স্যাংশনের ফলে ভেনেজুয়েলার তেলের মূল্য কমে যায়, আন্তর্জাতিক সব বাজার বন্ধ হয়ে যায় এবং উন্নত হতে থাকা দেশটি চরম সঙ্কটে পড়ে। স্মর্তব্য, এমন এক খাদ্য সঙ্কটে আমাদের বঙ্গবন্ধু সরকার পড়েছিল ’৭৪, ৭৫-এ! তবে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক গৃহীত সবুজ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলে তার সুবিধাভোগী হয়েছিল জিয়াউর রহমান! ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যায়, পৃথিবীর যে কোন দেশের যে কোন পণ্য বিক্রির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যম হচ্ছে ডলার। সুতরাং ডলার বাণিজ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে সুপার পাওয়ার করেছে- এর ওপর আঘাতের পাল্টা আঘাত ‘স্যাংশন’, যাকে গণমারণাস্ত্র বলেছেন গারিকাই চেংগু। অথচ ভেনেজুয়েলায় রয়েছে পৃথিবীর সবচাইতে বৃহৎ তেলক্ষেত্র এবং বিলিয়ন ডলারের খনিজ পদার্থ, বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণের মজুদ! তারপরও এটি এখন হয়ে পড়েছে দারিদ্র্যক্লিষ্ট কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্র বিরোধিতা এবং ডলার বাণিজ্য বিমুখতার প্রতি চরম স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপের ফলে! অবশ্য ভেনেজুয়েলা, ইরাক, ইরান, ইয়েমেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্যাংশন’ নামীয় গণমারণাস্ত্রের বিশদ আলোচনার পরিবর্তে ছয়জন সিনেটর ও একটি গোষ্ঠীর আমাদের দেশের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত করার নোংরা খেলার কথাই বর্তমান রচনার আলোচ্য। সম্প্রতি অনেক পরোক্ষ প্রমাণ থেকে একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে যে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা প্রণীত হয়েছে, যেটি বর্তমানের সফল মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার বিপুল ভোট লাভ করেও এ সরকারকে অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দেয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এখনও সে ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে সরকারকে বিপদে ফেলতে কাজ করে চলেছে! ১. এই ষড়যন্ত্রটি পরোক্ষভাবে প্রকাশিত হয়েছে যখন নির্বাচনে বিএনপি কোনরকম প্রচার কাজে নামেনি। ২. নির্বাচনে কয়েকজন প্রার্থীর ওপর ‘পরিকল্পিত’ হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ৩. বারবার নির্বাচন বর্জনের পথটি খোলা রেখেছে এবং নির্বাচনকে নির্বাচনের পর নানা দূরভিসন্ধিমূলক বক্তব্য/মন্তব্য যেমন- আগের রাতে ব্যালট বাক্স ব্যালট পেপার দিয়ে ভরে রাখা, ভোটারদের নৌকায় ভোটদানে বাধ্য করা, পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া ইত্যাদি মিথ্যা বলে বলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেন সম্ভব হয়। সেই কারণে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচন করে। তবে বিএনপির মিত্র জামায়াত এই নীলনক্সা আগেই জেনে নির্বাচন শেষ হয়ার পূর্বে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়, যা নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তোলার কাজটিকে অবাধ করার পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা চলে। ৪. কিছু সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রে অর্থ দিয়ে গু-া-পা-াদের ভাড়া করা হয় ভোটারদের ভোটদানে বাধা দেয়ার জন্য! কিন্তু যেহেতু এবার ভোট হয়েছে ’৭০-এর নির্বাচনের মতোই মুক্তিযুদ্ধের সুরক্ষার প্রশ্নে, সেজন্য আমাদের পাওয়া খবর সূত্রে দেখা যায় যেসব ভোটার বাধাগ্রস্ত হয়েছিল তারা প্রায় সবাই ছিল নৌকার ভোটার! ৫. অধিকাংশ নির্বাচনী কেন্দ্রে বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দেয়নি, দিলেও উপস্থিত থাকতে নিষেধ করেছিল, যাতে পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ করতে পারে। ৬. তবে, সবচাইতে বিশাল ষড়যন্ত্রটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে নিয়ে নির্বাচনের পরদিন প্রেস ব্রিফিং-এ ব্যালট বাক্স আগের রাতে ভর্তি করা, প্রার্থীদের মামলা, হামলা দিয়ে অসমান ক্ষেত্র তৈরি, ভোটারদের ভোটদানে বাধাদান, পোলিং এজেন্ট থাকতে না দেয়া ইত্যাদি অভিযোগ তুলে এ নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য, বিতর্কিত, অগণতান্ত্রিক হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত দেয়ার প্ল্যান ছিল। এ সঙ্গে নতুন নির্বাচন দিতে সরকারকে নির্দেশও দেয়া হতো। উক্ত সব অভিযোগ আমরা বিএনপির মুখে যেমন শুনেছি তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের কজন সিনেটরের মুখে, এমনকি প্রখ্যাত এক আমেরিকান সাংবাদিকের মুখেও একই কথার পুনরাবৃত্তি শুনে সন্দেহ থাকে না যে, এই নির্বাচনকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রে তারেকের সঙ্গে বিদেশী একটি গোষ্ঠীও সংশ্লিষ্ট ছিল ও আছে। দেশে তো আছেই, তা না হলে বিজয়ী প্রার্থীদের শপথ নিতে বাধা দেয় একটি মিথ্যার ফুলঝুরি দিয়ে সাজানো সরকারবিরোধী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য। ৭. সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রে ছয় সিনেটর প্যান্টাগনকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার আবেদন জানাচ্ছে, একই সঙ্গে দেশে নির্বাচনে কারচুপির ওপর গণশুনানি করছে তারেক-মিত্র গোষ্ঠীটি! জিনিসটি দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো নয় কি? এদের আরেকবার জানাতে চাই, নির্বাচনের আগে যখন এদেশের অবসরপ্রাপ্ত সামরিক, বেসামরিক সব পেশাজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র-শিক্ষক, তথ্য প্রযুক্তিবিদ, কৃষক, শ্রমিক বর্তমান সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী দলকে এবং দলনেত্রীকে সমর্থন দিয়েছেন, তখন নির্বাচনের ফল তো এটিই হওয়ার কথা, তাই নয় কি? তাদেরকে এবং বিদেশীদের একটি প্রশ্ন করি- ঐসব মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী পেশাজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, তরুণ প্রজন্মসহ ভোটাররা যদি শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে ভোট না দিত তাহলে তারা অন্য কোন্্ নেতা, নেত্রী বা দলকে ভোট দিত? এবং কেন দিত? বিএনপিকে বা খালেদা তারেকের কি অল্প কিছু জামায়াত-দুর্নীতি, হত্যার আসামি ছাড়া জনগণ ভোট দিত? কেন দিত? এদের অতীত বহু অপকর্মের জন্য কখনই জনগণের ভোট এবার পেত না। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের বলব- ‘অয়েল ইন ইয়োর ওন মেশিন’, তোমরা কি মূল্যবান বস্তু পেলে নতজানু হও? প্রকৃত গণতন্ত্র তোমাদের কাছে যখন হয় অন্য দেশের, এখানে ভেনেজুয়েলায় বিরোধী দলের নেতাকে অগণতান্ত্রিক এবং নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়, তখন তোমাদের কাছে আর যাই হোক, গণতন্ত্রের সবক তোমাদের কাছ থেকে নেব না। তোমাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার যোগসাজশ নিয়ে কেন পেন্টা অনুসন্ধান করে? এটা কি গণতন্ত্র? এটাকে কি তোমরা কোন্্ লজ্জার বিষয় মনে কর? তোমাদের আমরা ইরাক, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, ইরান, ইয়েমেনে কোন্্ মানবাধিকার রক্ষা করতে দেখছি? লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু হত্যার পরও তোমরা তোমাদের সরকারকে মানবাধিকার রক্ষা করতে বলেছ? শেম টু ইউ। প্রধানমন্ত্রী, আমরা আমাদের নির্বাচনে ভবিষ্যতে বিদেশী কোন নির্বাচন পর্যবেক্ষক চাই না। কেননা ওরাও অপরাজনীতির ধারক। প্রশ্ন হচ্ছে- ওদের নির্বাচনে পর্যবেক্ষণে যদি আমরা না যাই তাহলে ওরা কেন আমাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য এত ব্যাকুল? আইন করে এ অনাচার বন্ধ করুন। সত্যই ভারত বা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে নির্বাচনে যদি বিদেশী পর্যবেক্ষক প্রয়োজন না হয়, তাহলে আমাদের যথেষ্ট গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষকের কোন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে দেশী পর্যবেক্ষক আমাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে। পরিশেষে মহাজোটের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলোকে বলব, নির্বাচন নিয়ে ঐ শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীটি যদি দেশে আসার সুযোগ পেত তবে যে স্বস্তিতে আপনারা এখন আছেন সেটি কখনই পেতেন না। সরকারকে বিশাল সঙ্কট মোকাবেলা করতে হতো, যা এখনও হচ্ছে। সিনেটররা এখনও তাদের প্রাপ্য সম্ভবত হাতে পায়নি। সেজন্য তারাও এখনও নীরব হয়নি। এ অবস্থায় আমাদের জাতির সুরক্ষার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী একটি বিরোধী দল মুক্তভাবে গড়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন, যেটি মহাজোটের শরিক দলগুলো মিলে গড়ে তুলতে পারে। এটা তো সত্য যে, দেশ ও জাতির শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করতে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সরকারী দল ও বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই এখন দরকার। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×