ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চকবাজারে এক মায়ের আর্তনাদ

‘এক টুকরো মাংস, একটু ছাই হলেও দেও বুকে নেব’

প্রকাশিত: ১০:৪০, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 ‘এক টুকরো মাংস, একটু ছাই হলেও দেও বুকে নেব’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পাঁচ বছরের সানিন বসে আছেন মায়ের অপেক্ষায়। মাকে নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু তার মাকে যে চেনাই যাচ্ছে না। এসেছেন রোহানের মা। বৃহস্পতিবার যে মা আর্তনাদ করেছিল এক টুকরো মাংস, একটু ছাই হলেও দেও বুকে নেব। সেই মায়ের অপেক্ষা শুক্রবারও শেষ হয়নি। চুড়িহাট্টায় প্রাণ হারানো স্বজন থেকে শোক ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। শুধু তারাই নয়, কাঁদছে এখন গোটা দেশ। সকলের একটাই চাওয়া নিমতলীর পর চুড়িহাট্টা আর যেন কোনদিন এত কান্না কাঁদতে না হয়। প্রাণ হারানো ৬৭ জনের মধ্যে ৪৬ জনের মরদেহ হস্তান্তর করেছে ঢাকা জেলা প্রশানক। বাকি ২১ মরদেহ চেনাই যাচ্ছে না। পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার একমাত্র উপায় ডিএনএ পরীক্ষা। মাকে না নিয়ে বাড়ি ফিরব না ॥ আগুনের ঘটনায় ছোট্ট সানিনের মা বিবি হালিমা বেগম শিলা এখন নিখোঁজ মানুষের তালিকায়। ঘটনাস্থল থেকে সানিনদের বাসার দূরত্ব ২০০ গজ হলেও সেই বাড়িটি বেঁচে গেছে। কিন্তু মৃত্যু শিলাকে টেনে নিয়েগেছিল সেই নরকে। মোহাম্মদ সুমনের চকবাজারে ব্যাগের দোকান। সেই সূত্র ধরে শিলাদের চকবাজারেই ঝুঁকি নিয়ে বসবাস। পুরানো ঢাকার ঘিঞ্জিগলি পথ, রাসায়নিক আর ছোট ছোট কারখানাই বলে দেয় শহরে এমন জীবন বেমানান। এরপর সুমন, শিলা আর সানিনদের ঠিকনা এটাই। তাই হুট করে মৃত্যু এসে যে কাউকে নিয়ে যেতে পারে। সেদিন রাতে শিলা ওষুধ কিনতে নেমেছিল সানিনের জন্য। কিন্তু সেই ওষুধ কিনে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। সানিন এখনও তাই মায়ের প্রতীক্ষায় যদি মা ফিরে আসেন ওষুধ নিয়ে! শিলার বোনের স্বামী মোঃ বেলাল হোসেন জানালেন, ঘটনার দিন রাতে সানিন একটু অসুস্থ ছিল। তার বাবা সুমন বাইরেই ছিল। তাই শিলা নিজেই ওষুধ কিনতে নামে। কিন্তু আর ফিরে যাননি। ধারণা করা হচ্ছে এই আগুনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে শিলা। কিন্তু যেসব মরদেহ চেনার উপায় নেই তার মধ্যেই থাকতে পারেন শিলা। শিলার ভাই ইসরাফিল জানালেন, সানিনকে বাসায় রাখা যাচ্ছিল না। শেষে বলেছি তোমার মা এখানে আছে। এখন এখান থেকে আর নেয়া যাচ্ছে না। বলছে মাকে না নিয়ে যাবে না। কিন্তু মাকে কোথায় পাওয়া যাবে। রোহানের মায়ের অপেক্ষাটা বেড়ে গেল ॥ বৃহস্পতিবার সারাদিন রোহানের মায়ের আর্তনাদে চোখে জল আসেনি এমন একজনতেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। টেলিভিশনগুলো বারবার সেই মায়ের আর্তনাদ প্রচার করেছে। মা বলেছিলেন এক টুকরো মাংস এনে দেও একটু ছাই ভষ্ম এনে দেও বুকে নেব। কিন্তু সেই মায়ের বুকে শুক্রবারও ফিরিয়ে দেয়া যায়নি আদরের ধনকে। শুক্রবার তিনিও নিজের নমুনা দিতে এসেছিলেন। যদি মেলে এক টুকরো মাংস একটু ছাইভষ্ম। বোনের বিয়ের বাজার করতে গিয়েছিল রোহান। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রের সঙ্গে ছিল আর চার বন্ধু, তাদের একজন হারিয়েছে জীবন। তবে এই মায়ের কান্নার পথ আরও দীর্ঘ হবে। সিআইডি’র ফরেনসিক বিভাগের ডিএনএ এ্যাসিস্ট্যান্ট এ্যানালাইসিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন বলেন, স্বজনদের কাছ থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে যা পরীক্ষায় খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। চার সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারব। তবে ঘটনাস্থল থেকে দগ্ধ মরদেহের যেসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তা পরীক্ষা সময় সাপেক্ষ। একেকটা আলামতের ওপর তা নির্ভর করছে। একেকটার জন্য একেক ধরনের সময়ক্ষেপণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এই বক্তব্যই বলে দিচ্ছে সানিন, রোহানের মায়ের অপক্ষোর পথ একটু দীর্ঘ হবে। মৃত্যুই টেনে নিয়েছিল আগুনের নদীতে ॥ চাকরিজীবী স্ত্রীকে পুরান ঢাকার আশিক টাওয়ারে আনতে গিয়েছিলেন স্বামী লিপু। সঙ্গে ছিল শিশু সন্তানও। আশিক টাওয়ার থেকে নন্দ কুমার দত্ত রোড দিয়েই বাসায় ফেরার পথ। আশিক টাওয়ারের সিসি টিভি ফুটেজ বলছে ঘটনার একটু আগেই লিপু স্ত্রী নাসরিন জাহান আর ছেলে আবু তাহিরকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। কিন্তু কোথায় তারা ঘটনার পর আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বজনদের উদ্বিগ্ন চোখ এখনও মেডিক্যালের মর্গে। কিন্তু সেখানে যাদের রাখা হয়েছে তাদের চেনার উপায় নেই। নাসরিনের ভাই আনোয়ার হোসেন রনি জানলেন, বোন ভগ্নিপতি আর ভাগনের লাশ খুঁজছেন তারা। কিন্তু অবশিষ্ট কাউকেই চেনা যাচ্ছে না। তিনি জানান, অগ্নিকা-ের সূত্রপাতের ১০ মিনিট আগে তারা সেখান থেকে বের হয়ে রাড়ির দিকে রওনা দেয়। সেটা অফিসের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেছে দেখা গেছে। আমার বোন ইডেন কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে এমকম শেষ করে হাজী সেলিমের মালিকানাধীন আশিক টাওয়ারের এ্যাকাউটেন্ট হিসেবে কাজ করতো। রনি বলেন, ‘ঘটনার রাতে বোন, বোন জামাই ও তাদের ছেলে এক সঙ্গেই ছিল। আশিক টাওয়ার থেকে তাদের বাসায় যাওয়ার একটাই রাস্তা। ওই রাস্তাতেই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। হয়তো ২-৪ মিনিট সময় পেলে তারা আগুন থেকে বেঁচে যেতে পারতো। আমার আম্মা বোনের মরদেহ শনাক্তের জন্য ডিএনএ নমুনা জমা দিতে এসেছে। আর ভগ্নিপতির জন্য তার বাবা লালমিয়া ডিএনএ দিতে এসেছেন। ভেঙ্গে গেল স্মৃতির রঙ্গিন স্বপ্ন ॥ বৃহস্পতিবার সাহেব উল্লাহর নামটি উচ্চারিত হয়েছিল সেদিনের সব থেকে দুঃখী মানুষ হিসেবে। ওইদিন একটি নয় দুই ছেলের লাশ উঠেছিল তার কাঁধে। সেদিন জানা যায়নি এই মৃত্যু কেড়ে নিয়েছে স্মৃতির রঙিন স্বপ্নকে। মাত্র ২৬ দিন আগে যে শরীরে চেপেছিল লাল বেনারশি সেখানে কিনা এখন বিধবার সাজ। গত ২৮ জানুয়ারি ধুমধাম করে মেয়ে আফরোজা সুলতানা স্মৃতির বিয়ে হয় মাহবুর রহমান রাজুর সঙ্গে। চুড়িহাট্টার আগুন রাজুকে কেড়ে নিয়েছে। রাজুর শ্বশুর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এই ছিল আমাদের কপালে। এখন শোকে পাথর মেয়েটাকে কেমন করে সামলাই। মাস না ঘুরতেই আমার মেয়ের বিধবার সাজ। বাবা হিসেবে এই ঘটনা মেনে নেয়া আমার জন্য সব থেকে কষ্টের। রাজুরা তিন ভাই। রানা টেলিকম নামে তাদের দোকান চকবাজারে। সেখানে ফোন-ফ্যাক্স মোবাইল সরঞ্জাম বিক্রি করতো তারা। ছোট্ট ভাইকে নিয়ে বাবা-মাসহ ঢাকাতেই চুড়িহাট্টার পাশের একটা ভবনে থাকত। এই আগুন রাজু আর রানাকে বিদায় জানালো। নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে চিরশান্তিতে ঘুমিয়েছে যখন রাজু তখন স্মৃতির বুক জুড়ে কেবলই হাহাকার।
×