ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বছরের পর বছর অনুপস্থিত থেকেও সুবিধা নিচ্ছেন অনেক শিক্ষক

কুড়িগ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা বেহাল

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 কুড়িগ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা বেহাল

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রামের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বছরের পর বছর অনুপস্থিত থেকেও সরকারী সুযোগ-সুবিধার ভোগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় শিক্ষকরা অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে অবগত হলেও নীরব ভূমিকায় প্রশাসনসহ শিক্ষা বিভাগ। সরেজমিনে দেখা যায়, ৩০ জানুয়ারি জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার কেদার ইউনিয়নের ঢলুয়াবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ শিক্ষকের পরিবর্তে উপস্থিত ৩ জন। প্রায় ২শ’ ৫০ শিক্ষার্থীকের পাঠদান করাচ্ছেন তিনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছুটিতে থাকলেও অপর সহকারী শিক্ষক সানজিদা শারমিন ২০১৬ সালের ২ এপ্রিল যোগদান করার পর থেকে আর বিদ্যালয়ে আসেননি। তার স্বামী পেশায় কাস্টমস ইনস্পেক্টর আর শ্বশুড় উপজেলা শিক্ষক নেতা হাফিজুর রহমান বাবু। একই উপজেলার কচাকাটা ইউনিয়নের টেপারকুটি মোল্লাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ শিক্ষকের মধ্যে উপস্থিত মাত্র ২জন। এই ২জনই ১৫০ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাচ্ছেন। উপস্থিত নেই প্রধান শিক্ষকও। এখানে সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার ২০১৫ সালে যোগদানের পর বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। তার বাবা আব্বাস আলী একজন অবসরপ্রাপ্ত সাবরেজিস্ট্রার। তার বাড়ি ভুরুঙ্গামারী শহরেই। ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথরডুবি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খন্দকার শামীমা সুলতানা স্বর্ণালী ২০১৬সালের ১জানুয়ারি যোগদান করেন। তিনি একই বছরের ২৩সেপ্টেম্বর থেকে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। অভিযোগ রয়েছে, তিনি এখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের বাসুরভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ২শ’ ৫০ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাচ্ছেন একজন ভাড়াটিয়া শিক্ষকসহ ২ সহকারী শিক্ষক। এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিউলি বেগমও অনিয়মিত। তিনি মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দেন। আর তার স্বাক্ষরিত তারিখবিহীন ছুটির দরখাস্ত তৈরি থাকে। কেউ বিদ্যালয় পরিদর্শনে গেলেই দরখাস্তে তারিখ বসিয়ে ছুটি দেখানো হয়। ঘটনার সত্যতা মেলে ২৯ জানুয়ারি বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতায় প্রধান শিক্ষক গোলাপ উদ্দিন এবং সহকারী শিক্ষক শিউলি বেগমের স্বাক্ষর নেই। শিউলি বেগমের স্বামী ঢাকায় কর্মরত পুলিশ ইনস্পেক্টর। তিনি নিয়মিত বিদ্যালয়ে না এসে ঢাকায় অবস্থান করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাঁচগাছি আশরাফিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮ শিক্ষকের মধ্যে মাত্র একজন উপস্থিত হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে এসব শিক্ষক এবং তাদের স্বজনরা প্রভাবশালী হওয়ায় সহকারী শিক্ষকরা প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। ফলে প্রভাব বিস্তার করেই শিক্ষা বিভাগ এবং প্রশাসনের নাকের ডগায় বসেই অনিয়মতি থেকেও সরকারী সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। শিক্ষকদের এমন অনিয়মের কারণে জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাসুরভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কনা বলেন,শিউলি আপার ব্যাপারে প্রধান শিক্ষকই ভাল বলতে পারবেন। এই বিদ্যালয়ের ভাড়াটিয়া শিক্ষক একরামুল হক স্বীকার করেন, তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্কট থাকায় বেতন ছাড়াই স্বেচ্ছাশ্রমে পাঠদানে সহযোগিতা করছেন। সহাকারী শিক্ষক শিউলি বেগম ফোনে জানান, প্রধান শিক্ষককে বলেই তিনি উপজেলা শিক্ষা অফিসে এসেছেন। হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর না করে তিনি উপজেলায় কি করছেন এমন প্রশ্নে ফোন কেটে দেন। ঢলুয়াবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমিনুল ইসলাম ও ফেরদৌসী জানান,সানজিদা শারমিন দীর্ঘদিন থেকে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন। কিন্তু বেতনভাতাদি তুলছেন কিনা আমরা জানি না। টেপারকুটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জহুরুল ও লাইলী বলেন, শিরিন আপা বহুদিন থেকে বিদ্যালয়ে আসে না। বিষয়টি প্রধান শিক্ষক কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। নাগেশ্বরী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোসলেম উদ্দিন শাহ্ জানান, বিষয়টি আমি জানার পর প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়ে এ্যাকশন নেবার জন্য আমার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে কপি দিয়েছি। জেলা শিক্ষা অফিসার স্বপন কুমার রায় চৌধুরী বলেন, এই বিষয়ে তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় সরকারী ১ হাজার ২শ’ ৩৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে চরাঞ্চলে ২০৬টি। জেলায় প্রধান শিক্ষকের ১ হাজার ২শ’ ১৯টি পদের মধ্যে কর্মরত ১ হাজার ৭২ জন। সহকারী শিক্ষক ৬ হাজার ১শ’ ১৩টি অনুমোদিত পদে সহকারী শিক্ষক কর্মরত আছে ৫ হাজার ৮শ’ ১৭জন। গত এক বছরে অনুপস্থিতিসহ অন্যান্য অভিযোগের ভিত্তিতে জেলায় বিভাগীয় মামলা হয়েছে প্রায় ২০টি। এর মধ্যে তিরস্কার, ইনক্রিমেন্ট কর্তনসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় ৫ জনের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হাফিজুর রহমান বলেন, মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে সরকার কঠোর অবস্থানে। কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবার সুযোগ নেই। শিক্ষক অনুপস্থিতির তথ্য এবং তালিকা পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দেন তিনি।
×