ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এবার লড়াই হোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

এবার লড়াই হোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে

৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় সংসদের একাদশতম নির্বাচন। এবারের নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আর উৎসাহ ছিল সমানে-সমান। ২০০৮-এর পর আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমাদের উৎসাহিত করেছে। আবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে যে অগ্নিসন্ত্রাস তার দুঃসহ স্মৃতি সময়ে সময়ে আমাদের ভাবিয়েছেও। তবে শেষমেশ উৎসবমুখর পরিবেশেই সম্পন্ন হয়েছে জাতীয় সংসদের একাদশতম নির্বাচন। গত নির্বাচনপূর্ব ও পরবর্তী নির্বাচনী সহিংসতা সব রেকর্ডকে যেখানে ছাপিয়ে গিয়েছিল সেখানে এবারের নির্বাচনে নির্বাচনকালীন সহিংসতা ২০০১ পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় সবচাইতে কম। একটি সহিংসতাও অবশ্যই অনাকাক্সিক্ষত আর একেকটি জীবন অমূল্য তো বটেই। কাজেই আত্মতুষ্টির জায়গাটা নেই ঠিকই, তবুও নির্বাচনী সহিংসতার নিম্নগামী ট্রেন্ড ছিল আশা জাগানিয়া। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোন ধরনের সহিংসতার অনুপস্থিতি এবারের নির্বাচনকে আলোকিত করেছে। এবারের নির্বাচনে আমরা এমন একটি জাতীয় সংসদ পেয়েছি যেখানে কোন রাজাকারের পদচারণা আমাদের গণতন্ত্রের এই সর্বোচ্চ পাদপীঠকে কলঙ্কিত করবে না। ১৯৭৩-এর পর এবারই প্রথম আমরা এমন একটি প্রায় কলঙ্কমুক্ত সংসদ পেয়েছি যেখানে রাজাকারের সন্তান থাকলেও, নেই কোন রাজাকার। ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করে ২২ জন জামায়াতী এবার পরাজিত হয়েছে। ৩ জন জামায়াতী হেরেছে স্বতন্ত্র দাঁড়িয়েও। সংসদে ঢোকার জামায়াতী সব অপকৌশল এবার বাঙালী ব্যর্থ করে দিয়েছে। ভারত ভাগের পর এই প্রথম জামায়াতীরা নামে-বেনামে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের কোন সংসদে একটিও আসন জিততে ব্যর্থ হলো। ১৯৯১-এর পর থেকে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট ক্রমাগতই বেড়েছে, তা তারা ক্ষমতায় আসুক আর না-ই আসুক। আরও লক্ষণীয়, আওয়ামী লীগ যে কয়বার নির্বাচনে হেরেছে প্রতিবারই তাদের জনসমর্থনের পাল্লা ছিল ক্ষমতাসীনদের চেয়ে ভারি। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৮৫ শতাংশ ভোটারের সমর্থনে ২৮০টিরও বেশি আসনে জয় পেয়েছে। দু’কোটিরও বেশি প্রথম ভোটারের সমর্থন তাদের প্রতি ছিল নিরঙ্কুশ। ’৭৫-এর পর থেকে ইতিহাস বিকৃতি আর বিকৃত ইতিহাস চর্চার যে নির্লজ্জ আস্ফালন আমরা দেখেছি তাতে জাতি শুধুই বিভক্ত হয়েছে। কেউ কেউ যখন জয় বাংলা স্লোগানে উচ্চকিত হয়েছি, তখন অন্যরা বাংলাদেশ জিন্দাবাদে গলা ফাটিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কারও-কারও কাছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আর অন্যদের কাছে শত্রু ছিল হানাদার বাহিনী। আবার সদ্য মির্জা ফখরুলের জবানীতে জানতে পারছি সেটা ছিল পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে। এবারের নির্বাচন ছিল এসব বিভ্রান্তিকে পিছনে ফেলে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার নির্বাচন। ১৯৭০-এও ৩০ শতাংশ মানুষ বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি। একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ম্যান্ডেট ছিল না তাদের। অথচ এবার ৮৫ শতাংশ মানুষ চাইছে আগামীর বাংলাদেশ হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আর রাজাকারমুক্ত। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে সামনে রেখে আমরা যখন বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে তখন এর চেয়ে সুখের বিষয় আর কি হতে পারে? আব্রাহাম লিংকন ছিলেন আমেরিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু জাতির পিতা নন তিনি। আমেরিকার স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পরে তিনি দীর্ঘমেয়াদী, রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, বহু বছরে প্রতিষ্ঠিত যে গণতান্ত্রিক আমেরিকা সে তুলনায় ’৭৫ পরবর্তী বিভ্রান্ত, বিভক্ত বাঙালী জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করতে শেখ হাসিনার সময় লেগেছে তার চেয়ে ঢের কম। আর আব্রাহাম লিংকনের মতো সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, বরং মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিকে আপন করেই তিনি জয় করেছেন কোটি বাঙালীর হৃদয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে, এই বাস্তবতা অনস্বীকার্য। বারবার যুক্তি আর তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তা প্রমাণ করাটাও নিষ্প্রয়োজন। উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। উন্নয়ন হয় সব সরকারের আমলেই। হবেও তাই। পার্থক্য শুধু এই যে, কোন কোন সরকারের সময় উন্নয়নের ঠেলাগাড়ি চলে কানাগলিতে আর প্রধানমন্ত্রী যখন শেখ হাসিনা, তখন তা উর্ধশ্বাসে ছোটে মহাসড়কে। আমি নিশ্চিত জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই মেয়াদেই আমি ঢাকার এ মাথা থেকে ওমাথা ছুটব মেট্রোরেলে। তিনি না হয়ে অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হলেও হয়ত ঢাকায় মেট্রোরেল চলত, হয়ত আরও দশ, বিশ কিংবা ত্রিশ বছর পরে। তবে শেখ হাসিনার মেট্রোরেল আর ওদের মেট্রোরেলের পার্থক্য এই যে, শেখ হাসিনার মেট্রোরেল নিশ্চিন্তে আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে আর ওদের মেট্রোরেলে চড়লে আপনি আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতেও পারেন, আবার নাও পারেন। যে কেউ যে কোন সময় ওদের মেট্রোরেলে আপনার গলাটা কেটে রেখে যেতে পারে আর যদি তাই হয় তবে আপনি নিশ্চিত জানতে পারেন যে- আপনার পরিবার এর কোন বিচার পাবে না। একজন শেখ হাসিনার সার্থকতা এখানেই। তাই তাঁকে শুধুই উন্নত বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে চিহ্নিত করলে তা হবে ইতিহাসের প্রতি অন্যায় করা। এই বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সবটুকু কৃতিত্ব তার। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু আর জাতীয় চার নেতার হত্যাকা-, ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ আর সর্বশেষ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে বের করে এনেছেন তিনিই। এদেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৃতিত্বটুকুও তারই। আমরা চাই এবার তাঁর লড়াই হোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহারে। মাদকের বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স নীতি আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে, আগামীর উন্নত বাংলাদেশের আগামীর নাগরিকরা মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবে না। তাদের প্রাণশক্তিতে ভর দিয়ে বাংলাদেশ আগামীতেও ছুটতেই থাকবে। শেখ হাসিনা কথা দিলে কথা রাখেন, স্বপ্ন দেখালে স্বপ্ন পূরণ করেন। আমি খুব জানি আজকে তাঁর জাদুর স্পর্শে কালকের বাংলাদেশে দুর্নীতি পালাবে জাদুঘরে। তবে আমার দৃষ্টিতে শেখ হাসিনার সবচাইতে বড় লিগেসি তিনি একটি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভিতটুকু করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের যে বাংলাদেশ, তার চারটি সাংবিধানিক ভিত্তিকেই ধসিয়ে দেয়া হয়েছিল ’৭৫-এ তার হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত ঘোষিত অবৈধ সরকারগুলোর আমলে। আগামীর ইতিহাসের শুদ্ধতাকে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন চলমান ইতিহাসকে ঠিকপথে তুলে এনে। আমার পরম প্রশান্তি এই যে, বাংলাদেশের ৫০ আর বঙ্গবন্ধুর ১০০তম জন্মদিন উদ্যাপিত হবে তার রক্ত যার ধমনীতে বহমান, তার সেই যোগ্যতম উত্তরসূরির নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই! তার তুলনা শুধু তিনিই! আর তারপর যদি কেউ সেই বিশালত্বের বিন্দুমাত্র স্পর্শ করে থাকেন তবে তিনি শেখ হাসিনা এবং শুধু শেখ হাসিনাই! আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ যে শুধু এই দুটি অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করবে তাই নয়, বরং এই মেয়াদেই রচিত হবে ‘শেখ হাসিনা’স টেল’! ইতিহাসে তার স্থান এরই মধ্যে নির্ধারিত হয়ে আছে। এই মেয়াদে নির্ণীত হবে তার উচ্চতা, নির্মিত হবে তার লিগেসি! আমার পরম তৃপ্তি এই যে, তিনি এই যাত্রায় বেছে নিয়েছেন তার বিশ্বস্ততম আস্থাভাজনদের, খোল-নলচে বদলে ফেলেছেন তার মন্ত্রণালয় পরিষদ। আমার কাছে মনে হয়েছে নতুন উচ্চতায় তার এই নবযাত্রার সূচনায় এটি একটি সাড়ম্বর ঘোষণা। আমি তার নতুন মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, চেনার কথাও নয়। তবে চিনি অনুজপ্রতীম ডাঃ মুরাদ হাসানকে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সদ্য নিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী তিনি। আমরা একই সময় একই মেডিক্যাল কলেজে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। ঘনিষ্ঠভাবে কাটিয়েছি তারপরও বহু বছর। আমার কাছে তিনি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির প্রতীক। একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। বাবা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মী, জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। নিজ সন্তানকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে দেখে যেতে পারেননি তিনি। একজন মুরাদ হাসান তৃণমূল থেকেই রাজনীতি করে উঠে এসেছেন। এই চলার পথে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের রামদার কোপে নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল খসে পড়তে দেখেছেন। হাত থেকে বিচ্ছিন্ন সেই বুড়ো আঙ্গুল ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এনে পুনঃসংযোজন করা হয়েছিল। এমনি অসংখ্য পরীক্ষিত সেনানী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই যে বাংলাদেশ বিজয় আর ইতিহাসের সুউচ্চ শিখরের পানে তার এই যে স্বপ্ন যাত্রা, এতে তার ব্যর্থ হবার শঙ্কা নেই। স্বপ্নের এই ফেরিওয়ালা গড়বেন একের পর এক ইতিহাস, লড়াই করবেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, গৌরবান্বিত করবেন বাংলাদেশের ইতিহাসকে আর আমরা শুধুই স্বপ্নালু নয়নে তাকিয়ে দেখব আর গাইবো ‘জয়তু শেখ হাসিনা’! লেখক : চিকিৎসক ও গবেষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×