ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘পদ্মা সেতুর সাতকাহন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

‘পদ্মা সেতুর সাতকাহন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ক্রমান্বয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মাসেতু। সেই সঙ্গে ভেসে উঠছে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতার প্রতিচ্ছবি। খরস্রোতা পদ্মার বুকে একেকটি পিলার ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ় হচ্ছে জাতির মেরুদ-। অথচ দক্ষিণ বাংলাসহ সারাদেশের অর্থনৈতিক বিপ্লবের স্মারক এই সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল বিশ্বব্যাংক। সেই চক্রান্তের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দুর্নীতির অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণিত করে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতু নির্মাণের সেই ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগের নেপথ্য কাহিনীসহ সেতুর কল্যাণে সমৃদ্ধির সোপানে দেশের এগিয়ে চলার সেই আদ্যোপান্ত এবার উঠে এলো বইয়ের পৃষ্ঠায়। প্রকাশিত হলো ‘পদ্মাসেতুর সাতকাহন’ শীর্ষক গ্রন্থ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ও প্রাবন্ধিক সুভাষ সিংহ রায় রচিত বইটি প্রকাশ করেছে অনন্যা প্রকাশনী। বৃহস্পতিবার সকালে শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে বইটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর আতিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালিদ, জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন। বইটি নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করেন লেখক অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। পদ্মসেতু নির্মাণে কঠিন চ্যালেঞ্জের কথা উঠে আসে জামিলুর রেজা চৌধুরীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, এ ধরনের একটি মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নে যাওয়া ছিল চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। শুরুতেই পড়তে হয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণসংক্রান্ত জটিলতায়। ষড়যন্ত্রের কারণে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে আটকে দেয়া হয় ঋণ। সেই বাধা অতিক্রম করে নিজস্ব অর্থায়নে এগিয়ে চলছে পদ্মাসেতুর কাজ। পাশাপাশি এই সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতারও পরিচয় দিতে পেরেছি আমরা। এই প্রথম কোনো মেগা প্রজেক্টের তত্ত্বাবধানের সম্পূর্ণ কাজটি করছে বাংলাদেশীরা। এই সেতু নির্মাণে পদ্মার তলদেশের ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনফুট পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। তীব্র স্রতের কারণে বর্ষাকালে এখানে কোনো কাজ করা যায়নি। সেসব বিষয়কে সুচারুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আগামী এক বছর বা তার কিছু সময় পরই চালু হয়ে যাবে স্বপ্নের পদ্মাসেতু। প্রথমে বাস ও পরবর্তীতে সচল হবে রেল যোগাযোগ। আতিউর রহমান বলেন, এদেশের ইতিহাসের একটি গর্বিত অধ্যায় নিয়ে লেখা হয়েছে এই বইটি। কারণ, পদ্মাসেতু হচ্ছে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়ার মতো একটি ঘটনা। নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী সিদ্ধান্ত না নিলে এই ঘটনাটি ঘটতো না। ষড়যন্ত্রের কাছে মাথানত না করে তিনি বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, চাইলে আমরাও পারি। এই সেতুর বদৌলতে দক্ষিণ বাংলাসহ সারা দেশে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। পদ্মাসেতুর কল্যাণে দক্ষিণ বাংলা পরিণত হবে অর্থনৈতিক করিডরে। বঙ্গবন্ধু সেতু যেমন উত্তরবঙ্গ থেকে মঙ্গা তাড়িয়েছে, দক্ষিণবঙ্গের দারিদ্র্যতা তাড়াবে পদ্মাসেত। সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে দেশের জিডিপি বেড়ে যাবে আরও ১ শতাংশ। জিডিপি ডাবল ডিজিটে নিয়ে যাওয়ায় সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে পদ্মাসেতু। কৃষি উৎপাদন ও শিল্প উৎপাদন বাড়বে ৮ শতাংশ। কমবে দারিদ্র্য, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। তাই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সবাইকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি স্বপ্নের পথে হাঁটব নাকি ভূতের মতো পেছনের দিকে ছুটব। পদ্মাসেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তখন আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর। বিশ্বব্যাংক টাকা ছাড় করলে সবার আগে আমিই জানতাম। সুতরাং, টাকাই যদি না আসে, তাহলে দুর্নীতির প্রশ্নই উঠে না। স্বদেশ রায় তাঁর বক্তব্য বইয়ের নামের সঙ্গে কাহন শব্দটি যথার্থ নয় উল্লেখ করে বলেন, এই শব্দের মাঝে এক ধরনের নেতিবাচক ভাব চলে আসে। পরবর্তীতে লেখকরা এটি নিয়ে ভাববেন। পদ্মা সেতুকে দেশের আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির প্রতীক হিসিবে অভিহিত করেন একুশে পদকজয়ী এই সাংবাদিক। পদ্মাসেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রমূলক দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত সংবাদের যথার্থ উপস্থাপনে সংবাদমাধ্যমের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই সময়ে এদেশের সাংবাদিকতা একটা ধাক্কা খেয়েছে। এই ইস্যু নিয়ে মিডিয়ায় পরাধীন মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। ওই পরাধীন মানসিকতার কারণেই আমরা যে সৎ হতে পারিÑসেটি আমরাই বিশ্বাস করতে পারিনি। বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের পেছনে নোবেলজয়ী মোহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা নিয়ে পত্রিকায় লেখার পর অনেকেই আমাকে দালাল বলে আখ্যা দিয়েছে। আর এমনটা যারা করেছে মূলত তাদের মধ্যে কাজ করেছে পরাধীন দেশের মানসিকতা। সে কারণে সাদা মানুষরা মিথ্যা বললেও সেটাকেই সহজে গ্রহণ করে নেয়া হয়। ওই মানসিকতার কারণেই পদ্মাসেতুর মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে মিডিয়া ছিল ষড়যন্ত্রের পক্ষে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বদলে একের পর এক টেবিল মেকিং গল্প লেখা হয়েছে। অথচ সেসব সাংবাদিকরা দুর্নীতির অভিযোগের উৎসের সন্ধান করেননি। এমনকি এ ঘটনায় বিশ্বব্যাংকের তদন্ত দল এলে তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যানও আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সেই প্রেক্ষাপটে দুদদের কমিশনার মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন যখন দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত দলের কাছে দুর্নীতির না হওয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দিলেন তখন তাকে ছাত্রলীগের লোক বলা হলো। এই প্রেক্ষাপটে আত্মনির্ভরতার প্রতীক পদ্মসেতু থেকে আত্মবিশ্বাস নিয়েই সাংবাদিকতা করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। আব্দুল মান্নান বলেন, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে আত্মনির্ভরশীল দেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর দেশ পরনির্ভরশীল হয়ে যায়। তখন জাতীয় বাজেটের ৮০ শতাংশ বিদেশী ঋণ দিয়ে তৈরি হতো। এখন সেই অবস্থা থেকে আমরা অনেক এগিয়ে গিয়েছি। বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর অর্থছাড়ের আগেই দুর্নীতির গন্ধ পায়। এটা কোনভাবেই সম্ভব না। সরকারের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে বিশ্বব্যাংকের এ ভূমিকা ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পদ্মাসেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়টি ছিল অর্থনৈতিক উদ্যোগ। আর দুর্নীতির অভিযোগে ঋণ বাতিলের বিষয়টি ঘটেছিল প্রভাবিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। তাই অর্থনৈতিক সংগ্রামের মতোই রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের লড়তে হবে ভেতরের শত্রুদের বিরুদ্ধে। নানা কৌশলে মুহাম্মদ ইউনূস, মাহফুজ আনাম ও দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতো মানুষেরা পদ্মাসেতু নির্মাণ চাননি। এ ব্যাপারে তারা এখনো সক্রিয় রয়েছেন। এ বইতে উঠে এসেছে সেসব তথ্য। তাই গ্রন্থটিতে কোন বিভ্রান্তির পরিবর্তে রয়েছে স্বচ্ছতা। পঁচাত্তরের কক্ষচ্যুত হওয়া বাংলাদেশ আবার ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। এই সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করার মাধ্যমে ধরে রাখতে হবে দেশের সেই অগ্রযাত্রাকে। মোঃ শাহাবুদ্দিন বলেন, দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে পদ্মসেতুর দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোর কোন ভিত্তি ছিল না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে অভিযোগ এনেছিল বিশ্বব্যাংক। তখন অধিকাংশ মিডিয়াই কোন প্রমাণ ছাড়াই সেই অভিযোগের পক্ষে লিখেছে। অথচ কানাডার কোর্টে বিচারিক রায়ে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেই দুর্নীতির অভিযোগ। পঁচিশটির বেশি নিবন্ধের মাধ্যমে পদ্মাসেতু শুরুর কথা থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের ভুয়া অভিযোগ, সাজানো দুর্নীতির গালগল্প, সেতুর কারণে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্রসহ সেতুসংক্রান্ত নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে ‘পদ্মাসেতুর সাতকাহন’ শীর্ষক গ্রন্থে। দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উৎসর্গীকৃত বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন মানিক সরকার। ১৫৯ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির মূল্য রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা।
×