ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

নির্বাচনের আগে তিন দিন ফেসবুক বন্ধ রাখা প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

নির্বাচনের আগে তিন দিন ফেসবুক বন্ধ রাখা প্রয়োজন

ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অপব্যবহার করে কিভাবে ব্রাজিলের গত জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত, বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল, তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরে কয়েকদিন আগে জনকণ্ঠে একটি কলাম লিখেছিলাম। আশা করেছিলাম যে, ব্রাজিলের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা ফেসবুক এবং গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যাতে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা বিতর্কিত করা সম্ভব না হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফেসবুক এবং ইউটিউবে যেভাবে গুজব, ভুয়া সংবাদ এবং মিথ্যা বানোয়াট ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে মনে হয় না যে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছে। এ কথা সত্যি যে, নির্বাচন কমিশনের এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তীক্ষ নজর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নিশ্চয়ই আছে। তারা এ রকম গুজব সৃষ্টিকারী অনেককে শনাক্ত করে আটক করতেও সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এসব গুজব এবং অপপ্রচারের অধিকাংশই চালানো হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা বা প্রতিরোধ করা মোটেই সম্ভব হচ্ছে না। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ব্রাজিলের নির্বাচনের সময়। সেখানেও গুজব বা অপপ্রচারগুলো ছড়ানো হয়েছিল পার্শ্ববর্তী দেশ ভেনিজুয়েলা থেকে। ব্রাজিলের অভ্যন্তরে তাদের অনুসারীরা ভেনিজুয়েলা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করা গুজবগুলো দ্রুত ছড়িয়ে দিয়েছিল মাত্র। ফলে অনেক চেষ্টা করেও ব্রাজিল কর্তৃপক্ষ ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহযোগিতা নিয়েও অপপ্রচার কোনভাবেই বন্ধ করতে পারেনি। দেশেও এমন অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক এবং ইউটিউবে অপপ্রচার ও গুজব রটানোর মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণদের উস্কানি দিয়ে সত্য-মিথ্যার বেড়াজালে নির্মিত অপপ্রচারের এক ভিডিও পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ফেসবুক এবং ইউটিউবে। ভিডিওটি দেখলেই বোঝা যায় যে, এটি চিত্রায়িত হয়েছে বিদেশে এবং এটি আপলোডও করা হয়েছে বিদেশ থেকে। ভিডিও চিত্রের ভাষা এবং অভিনয়কারীর অঙ্গভঙ্গির যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। এই সংঘবদ্ধ অপপ্রচারের দল শুধু যে বিদেশ থেকে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তা নয়। তারা সর্বক্ষণ বাংলাদেশ বিশেষ করে সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সকল পোস্ট পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এবং বর্তমান সরকারের পক্ষে কোন পোস্ট দেখা মাত্র তা ফেসবুক কর্তৃপক্ষের নজরে আনছে। সেই পোস্টগুলো সরকারী মদদে প্রচারিত এমন দাবি করে সেগুলো বন্ধের দাবি করছে। যেহেতু বাংলাদেশে এখন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এবং এই নির্বাচনে ফেসবুকের অপব্যবহার হতে পারে বলে তারা ওয়াকিফহাল। তাই এ রকম অভিযোগ পাওয়া মাত্র ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফেসবুক পেজ বা আইডিগুলো তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দিচ্ছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে সরকারের এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারিত এ রকম প্রায় বিশটি ফেসবুক পেজ ও আইডি বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে দেখা যায় যে, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রচারণাগুলো আর থাকছে না। অথচ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের প্রচারণাগুলো বা গুজবের বিষয়গুলো একচেটিয়াভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা মূলত ভোটারদের বিভ্রান্তই করছে না, নির্বাচনকে প্রভাবিত এবং বিতর্কিতও করবে। শুধু তাই নয়, ফেসবুকে কোন পোস্টিং দিয়ে ডলার বুস্ট করার ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা অনেক এগিয়ে আছে। কেননা বিদেশে তাদের ডলারের কোন অভাব নেই। এই কারণে তাদের পোস্টিং বেশি বেশি ফেসবুকে আসতে থাকে এবং তা অধিকমাত্রায় লাইক পেতে থাকে, যা অপপ্রচার বা গুজব রটানোর ক্ষেত্রে এক মোক্ষম অস্ত্র। আমরা যতটুকু জানি, নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বক্ষণিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটর করছে এবং দেশের অভ্যন্তরে তা নিয়ন্ত্রণে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেইসঙ্গে বিটিআরসি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত (ডেডিকেটেড) টিম প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যাদের প্রধানতম কাজ হবে গুজব বা অপপ্রচারের পোস্টিং দেখা মাত্র তা ফেসবুক এবং ইউটিউব কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করবে এবং সেগুলো বন্ধের জন্য জোরালো আবেদন জানাবে। সরকারী তরফ থেকে এ রকম অভিযোগ পেলে তারা অনেক বেশি তৎপর হবে এবং দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশ এমব্যাসি থেকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়গুলো তুলে ধরে এমব্যাসির পক্ষ থেকে তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে দাপ্তরিকভাবে অভিযোগ দায়ের করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করতে হবে এবং তাদের ক্রমাগত তাগাদা দিয়ে সেটি করতে বাধ্য করতে হবে। আমি ইতোপূর্বে ব্যক্তিগতভাবে তথ্য-প্রমাণসহ ফেসবুক কর্তৃপক্ষের নিকট এ রকম অভিযোগ দায়ের করেছি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত আবেদনে তারা সাড়া দেবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারী চ্যানেলে এমন অভিযোগ পেলে তারা যথেষ্ট সাড়াও দেবে এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফেসবুকের অপব্যবহার এখন সর্বত্র আলোচিত এবং নিন্দিত। এগুলো নিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট তটস্থও থাকে। তাই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে তারা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য। যেহেতু নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে, তাই ফেসবুক এবং গুগলের সহযোগিতা নিয়ে এই ধরনের অপপ্রচার ও গুজব বন্ধ করার সময় পার হয়ে গেছে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই অপপ্রচার বা গুজব রটানোর মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা রুখতে হলে নির্বাচনের দিনসহ আগের তিন দিন ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখা প্রয়োজন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমন কোন অত্যাবশ্যিক বিষয় নয় যে, এগুলো দুই-তিন দিন বন্ধ থাকলে দেশ মহাসঙ্কটে পড়বে। এ কথা সত্যি যে, দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ফেসবুক আসক্ত। ফেসবুক বন্ধ থাকলে তাদের অনেকের ঠিকমতো ঘুম হবে না এবং এমনকি কারও কারও পাগল পাগল লাগবে। তার পরও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচনকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার করে প্রভাবিত বা বিতর্কিত করার অপচেষ্টা রুখে দেয়ার জন্য এই উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। শুধু তাই নয়, ফেসবুকের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন বা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা থেকে রক্ষা পাবার জন্য ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দুই-তিন দিন বন্ধ রাখা প্রয়োজন। ইতোপূর্বে এমন গুরুত্বপূর্ণ সময় ফ্রান্সসহ অনেক দেশেই ফেসবুক সাময়িক বন্ধ রাখার নজির আছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাময়িক বন্ধ রাখার বিপক্ষে সরকারী মহল থেকে যুক্তি থাকতে পারে যে, ফেসবুক বন্ধ হলে তাদের ভাল কাজের প্রচার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশের তরুণদের মাঝে পৌঁছানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তারা হয়ত খতিয়ে দেখেননি যে, তাদের ভাল কাজের প্রচার ফেসবুক বা ইউটিউবে পোস্ট হওয়া মাত্র তা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। সেটি কিভাবে হচ্ছে তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার বা দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রচারণা যতটা দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক দেখা যায় সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণা, গুজব এবং মিথ্যাচার। তাই আপাতত নির্বাচনের দিনসহ দুই-তিন দিনের জন্য ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সকল প্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দিয়ে দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমকে অনেক বেশি করে ভূমিকা রাখতে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। অবশ্য তারা নিজ থেকেই সেই দায়িত্বটি পালন করে চলেছে। বিশেষ করে দেশের প্রিন্ট মিডিয়া এবং অসংখ্য বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো খুব গুরুত্ব দিয়েই নির্বাচনের খবর প্রচার করে আসছে। এক্ষেত্রে অবশ্য দেশের একমাত্র সরকারী টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন বলতে গেলে নির্বাচন বিমুখ ভূমিকা পালন করছে বলেই প্রতীয়মান হয়। দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেখানে বিরামহীনভাবে দেশের নির্বাচনের খবরাখবর জনগণকে জানানোর কাজে ব্যস্ত, সেখানে বাংলাদেশ টেলিভিশন গানবাজনা ও নাটক প্রচারেই যেন বেশি মনোযোগী। জানি না বাংলাদেশ টেলিভিশন কার নির্দেশে এমন নির্বাচনবিমুখ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশের বেসরকারী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াও আজ দুই শিবিরে বিভক্ত। এর পরও তাদের একটা দায়বদ্ধতা আছে। তারা তাদের মতো করে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে এবং করছেও, কিন্তু তাই বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো যা খুশি তা লিখতে বা ছাপতে পারে না। তই নির্বাচনকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার বা গুজবের হাত থেকে প্রভাবমুক্ত রাখতে এই মাধ্যমগুলো সাময়িক বন্ধ রাখার কোন বিকল্প নেই। আশা করি, নির্বাচন কমিশন এবং বিটিআরসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখবে এবং এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন জরুরীভাবে। লেখক : ব্যাংকার টরন্টো, কানাডা [email protected]
×