ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাহিরা খাতুন সান্ত¡না

সেই আগের মঞ্চে আশরাফুল...

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৮

সেই আগের মঞ্চে আশরাফুল...

পাঁচ বছরের কিছু আগে ভুলটা করেছিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম গ্লোবাল স্টার, তুখোড় মেধাবী ক্রিকেটার হিসেবে তার নাম হয়েছিল ‘আশার ফুল’। ঘরোয়া থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক- সব ধরনের ক্রিকেট ফরমেটে অন্যতম আকর্ষণীয় ক্রিকেটার হয়ে উঠেছিলেন। কারণ, তিনি যখন ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতেন তখনই বড় কোন সাফল্য ধরা দিত দলকে। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন, একদিনের জন্য টেস্ট ক্রিকেটে দেশের পক্ষে সর্বাধিক ব্যক্তিগত ইনিংস খেলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো অপ্রতিরোধ্য প্রবল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম বিজয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন, ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও বিশ্ব টি২০ চ্যাম্পিয়নশিপে যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং-এমন অনেক কীর্তিতে নাম আছে তার। সেই আশরাফুল ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি২০ ক্রিকেট আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০ আসরে বাজিকরদের চক্রান্তের চক্রে নিজেকে জড়িয়ে হয়েছিলেন সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ৫ বছর নির্বাসিত। এর ৩ বছর পর ঘরোয়া আসরে খেলার সুযোগ উন্মুক্ত হলেও ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দুয়ার বন্ধই ছিল। এ বছর ১৩ আগস্ট সকল দুয়ার খুলে গেছে। সেই বিপিএলের মঞ্চেই আবার ফিরছেন তিনি। ষষ্ঠ বিপিএলে তিনি নতুন ঠিকানা পেয়েছেন চিটাগং ভাইকিংসে। ‘বি’ ক্যাটাগোরিতে থাকা আশরাফুল ১৮ লাখ টাকায় যোগ দিচ্ছেন এই দলটিতে। আর দল পেয়ে উচ্ছ্বসিত আশরাফুল দুর্দান্তভাবে ফেরার প্রত্যয় জানিয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালের দ্বিতীয় বিপিএল আসরে খেলেছিলেন আশরাফুল। তখন তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলেরও নিয়মিত খেলোয়াড়। সেই আসরে ঢাকার হয়ে খুলনার বিপক্ষে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ৫৮ বলে ১৪ চার ২ ছক্কায় অপরাজিত ১০৩ রানের একটি বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন। আসর শেষেই অভিযুক্ত হন স্পট ফিক্সিং কা-ে। সেই দোষ স্বীকারও করে নেন। শাস্তি স্বরূপ আন্তর্জাতিক ও ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট থেকে ৫ বছর এবং ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে ৩ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি। একটা অদৃশ্য দেয়াল চারপাশে, অদৃশ্য এক শেকলে বাঁধা পা- হাঁসফাঁস পরিস্থিতির মধ্যে চরম এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিলেন আশরাফুল এই ৫টি বছর। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট যদিও ঘরোয়া কিছু আসরে খেলার অনুমতি পেয়ে খেলেছেন গত দুই মৌসুম। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক আসরে খেলার জন্য তারপরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সে কারণে কারাভোগের মতো অস্বস্তিটা ঠিকই ছিল। অবশেষে ১৩ আগস্ট, ২০১৮ এর পর থেকে মুক্ত বিহঙ্গ হয়েছেন আশরাফুল। কি ঘটেছিল এ তুখোড় মেধাবী ক্রিকেটারের ভাগ্যে? একটি ফ্ল্যাশব্যাক করে সেটি জানা যাক। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আসর বিপিএল টি২০ আসর অনুষ্ঠিত হয়। আর এমন টুর্নামেন্টে থাকে টাকার ছড়াছড়ি এবং সে কারণেই জুয়াড়ি, ম্যাচ ফিক্সার আর দুর্নীতিবাজদেরও সমাগম ঘটে। তেমনই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের চক্রান্তে ফেঁসে ম্যাচ গড়াপেটায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন আশরাফুল। বিপিএলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৩ সালের ৩১ মে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তদন্ত শুরু করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল দোষ স্বীকার করে নেন এবং বিস্তারিত জানান। ৪ জুন বিসিবি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে। ২০১৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বিপিএল শুরু করে এন্টি করাপশন ট্রাইব্যুনালের শুনানি। এর মাঝেই (২ জুন, ২০১৪) আশরাফুল নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি আনঅফিসিয়াল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে আরেকবার বিতর্কের জন্ম দেন। সে বছর ১৮ জুন বিসিবি আশরাফুলকে ৮ বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করলে এর বিপক্ষে আপীল করেন ২২ জুলাই। ২৯ সেপ্টেম্বর বিসিবির শৃঙ্খলা কমিটি সার্বিক দিক বিবেচনা করে আশরাফুলের নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে ৫ বছর করে। তবে এর বিপক্ষে আপীল করে বিসিবি ও আইসিসি ২১ অক্টোবর। তবে সেই আপীল আর আমলে আনা হয়নি। ৩ বছর কমে যায় শাস্তি। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট থেকে আশরাফুলের ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে যায়। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট আসর এবং সবধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠেনি। সেখান থেকেও দীর্ঘ ৫ বছর অপেক্ষার পর ছাড় পেয়েছেন আশরাফুল। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র, সাবেক অধিনায়ক ও ওপেনারের সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যেই ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে নিজেকে অনেকখানিই ফিরে পেয়েছেন এবং আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে। বিশেষ করে গত বছরে ৫ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ঘরোয়া লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে। সে কারণে এবার বিপিএলে ভালভাবেই দল পাবেন তা নিশ্চিতই ছিল। সেটা সত্য হয়েছে। এবার পুরনো মঞ্চে ৩ আসর পর ফেরা। নিজেকে আগের মতো তেজী ব্যাটসম্যান হিসেবে ফিরে পাবেন আশরাফুল? লড়াইটা শেষ হয়নি, নিয়মিতই নতুন লড়াইয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন ‘আশার ফুল’। জাতীয় দলে ফেরার জন্য সচেষ্ট থাকার প্রত্যয় জানানো এ মেধাবী ব্যাটসম্যানকে অনেক পরীক্ষা দিতে হবে সেটা বর্তমান নির্বাচকরাই জানিয়েছেন। বরাবরই আশরাফুল মেধাবী ক্রিকেটার। সেই মেধাটা মাঠে না থাকলেও ফুরিয়ে যায়নি। দীর্ঘ সময় ব্যাট-বল হাতে না নিলেও তিনি নিজেকে ফিরে পান গত বছর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে (ডিপিএল)। সবাইকে বিস্মিত করে হাঁকান ৫টি সেঞ্চুরি। একটি লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট মৌসুমে বিশ্বের ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে এই কৃতিত্ব দেখান তিনি। ২০১৫-১৬ মৌসুমে মোমেন্টাম ওয়ানডে কাপে দক্ষিণ আফ্রিকার আলভিরো পিটারসন ৫ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর আশরাফুল ২৩টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে ৪৭.৬৩ গড়ে রান করেছেন। এবার বিপিএল নিয়ে তিনি বলেন, ‘বিপিএলের আগের তিন আসরে খেলতে পারিনি, তার জন্য কতটা কষ্ট হয়েছে, তা বলে বোঝাতে পারব না। সেই বিপিএলে ফিরতে পেরে তাই নিজের কাছে অনেক হালকা লাগছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে হাজার হাজার রান করেও আলোচনায় আসা যায় না। বিপিএলের খেলা যেহেতু টেলিভিশনে দেখায় এবং প্রতিষ্ঠিত বিদেশী ক্রিকেটাররা খেলে, তাই এ ধরনের আসরে ভাল পারফর্ম করলে অনেক আলোচনায় থাকা যায়। তাই বিপিএলে ফিরলে নিজের সেরাটা খেলতে চাই। আমি চাই অন্তত ৫টি ম্যাচ জেতানো পারফর্মেন্স করতে। চিটাগং কিংসে মুশফিক থাকায় আমার জন্য অনেক সুবিধা হয়েছে। ওর সাথে দারুণ বোঝাপড়া আছে। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে আমার সেরা ইনিংসটা মুশফিকের সঙ্গেই খেলেছিলাম। ও ডাবল সেঞ্চুরি করেছে, আমি অল্পের জন্য পারিনি।’
×