ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংশোধনাগারে রূপান্তর করে উপার্জনমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা

সব পুরনো কারাগার বন্দী উপযোগী করা হচ্ছে ॥ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে আড়াই শ’ গুণ বেশি বন্দী

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৬ অক্টোবর ২০১৮

  সব পুরনো কারাগার বন্দী উপযোগী করা হচ্ছে ॥ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে আড়াই শ’ গুণ বেশি বন্দী

মশিউর রহমান খান ॥ দেশের সকল পুরনো কারাগার ব্যবহার উপযোগী করে নতুন করে এসব কারাগারে বন্দী আটক রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে এসব পুরনো কারাগার সংশোধনাগারে রূপান্তরের অন্যতম স্থান হিসেবে কাজে লাগানো হবে। বর্তমানে দেশের ৬৮ কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় ২৫০ গুণ বেশি বন্দী আটক রয়েছে। তাই বর্তমান বন্দী সংখ্যাধিক্য হওয়ায় ও ক্রমবর্ধমান হারে দ্রুত বন্দীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রদত্ত অনুশাসন অনুযায়ী কারাগার সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে কারাগারে আটক বন্দীদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক নানা প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বন্দীর অপবাদ থেকে মুক্ত করে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা হবে। গত ৯ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের দেয়া প্রজ্ঞাপনে এ সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে উপসচিব মুহাম্মদ আব্দুর রউফ মিয়া স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন জেলায় নতুনভাবে নির্মিত কারাগারকে কারাগার-১ ও পুরনো কারাগারকে কারাগার-২ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এই আদেশ জারি করা হলো এবং এটা অবিলম্বে কার্যকর করা হবে। তবে বর্তমানের চলমান জনবল সঙ্কট দূর না করেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে কারাগারের নিরাপত্তা সঙ্কট দেখা দিতে পরে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। অপরদিকে এই সিদ্ধান্তের পর কারা কর্তৃপক্ষও দেশের কোন কোন পুরনো কারাগার ব্যবহার উপযোগী রয়েছে ও পুরনো কোন কোন কারাগারের জমি সরকারের কাছে এখনো হস্তান্তর করা হয়নি সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেশের সকল কারাগারে চিঠি পাঠিয়েছে। সরকারের এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিভিন্ন পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে বলে কারাসূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন করাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ৫ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত বন্দীও আটক রয়েছে। এসব কারাগারের বন্দীরা অতি মানবেতর জীবন যাপন করছেন। স্থান সংকুলান না হওয়ায় ও গরমের কারণে কোন কোন কারাগারে বন্দীগণকে বিশেষ ক্ষেত্রে বারান্দায়ও রাত কাটাতে হচ্ছে। সম্প্রতি দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে অনেক বন্দী হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। পরে এদের অনেককেই কারা হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা প্রদান করে পরিস্থিতি সামাল দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। ধারণ ক্ষমতার বাইরে বন্দী থাকায় একদিকে যেমন বন্দীদের আবাসন সংকট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমনি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশোধনাগারে রূপান্তরে বন্দীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মমুখী করার সরকারী উদ্যোগটিও ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে দেশের সকল কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কারাসূত্র জানায়, দেশের নতুনভাবে স্থানান্তর হওয়া সকল কারাগারকে কারাগার-১ ও সকল পুরনো কারাগারকে কারাগার-২ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। কারা অধিদফতর যেসকল কারাগার নতুনভাবে স্থানান্তর হওয়ার পর পুরাতন কারাগারের জমিও সরকারের কাছে বুঝিয়ে দেয়নি সেসব কারাগার প্রথম ধাপে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে এমন কিছু কারাগার রয়েছে যেসব কারাগার নতুন স্থানে স্থানান্তর করার পর সরকারের কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের জন্য ইতোমধ্যেই ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে তার তালিকা তৈরি করছে। এসব কারাগারের জমি পুনরায় উদ্ধার করার পর সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। কারাসূত্র জানায়, যে সকল জেলায় নতুন নতুন কারাগার নির্মাণ করা হয়েছে কিন্তু শতভাগ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় এখনো পুরনো কারাগারেই বন্দীদের আটক রাখা হচ্ছে সেসব কারাগারের স্থানকে অতি দ্রুততার সঙ্গে বন্দী আটক রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে কারাসূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া বন্দী স্থানান্তরের পর কয়েক বছর পার হয়ে যাওয়ায় এমন অনেক কারাগার রয়েছে যেসব কারাগারে এই মুহূর্তে বন্দী আটকের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে এসব কারাগারকে ব্যবহার উপযোগী করতে সংস্কারের মাধ্যমে বন্দী আটকের ব্যবস্থা করা হবে। কারা অধিদফতরের হিসেব মতে, বর্তমানে দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে। ৬৮ কারাগারে বর্তমানে বন্দী ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে ৩৬ হাজার ৬১৪ জন। এর বিপরীতে ১ অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে ৯২ হাজারের বেশি বন্দী আটক রয়েছে। অপরদিকে সরকারের নেয়া কারাগারকে সংশোধনাগারে রূপান্তরের প্রকল্প বাস্তবায়নে এই কারাগারগুলোকে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হবে বলে কারাসূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে অর্ধেকের বেশি বন্দী রয়েছেন যারা বয়সে যুবক। সমাজে নানা অপরাধের কারণে তারা বর্তমানে কারাগারে দীর্ঘদিন যাবত আটক রয়েছেন। তাদের সরকার স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে কারাগারের অভ্যন্তরেই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। এছাড়া সরকারী উদ্যোগে পুরাতন কারাগারগুলোকে আত্মকর্মসংস্থান তৈরিতে প্রশিক্ষণের অন্যতম স্থানে রূপান্তর করা হবে। বর্তমানে কারাগারে ২৭টি ট্রেডে বন্দীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। কারাসূত্র জানায়, পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দীন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ হাজারের মতো সেখানে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের পর বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার বন্দী আটক রয়েছেন। অতি দ্রুততার সঙ্গে বন্দী সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কারা কর্তৃপক্ষ সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকতে হয়। তাই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দীদের ধকল সামলাতে ও কারাগারকে প্রকৃত সংশোধনাগারে রূপান্তরে উদ্যোগটি অধিক কার্যকর করতে চায় কারা কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে দেশের ৬৮ কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় ২৫০ গুণ বেশি বন্দী আটক রয়েছে। এই সংখ্যা গত কয়েক বছর যাবত ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। ফলে বন্দীদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক কষ্ট স্বীকার করে কারাবাস কাটাতে হচ্ছে। তাই বর্তমানে বন্দী সংখ্যাধিক্য হওয়ায় ও ক্রমবর্ধমান হারে অতি দ্রুততার সঙ্গে বন্দীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার দেশের সকল পুরনো কারাগারকে ব্যবহার উপযোগী করে বন্দী আটক রাখতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রদত্ত অনুশাসন অনুযায়ী কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে কারাগারের আটক বন্দীদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক নানা প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বন্দীর অপবাদ থেকে মুক্ত করে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন কারাগারকে কারাগার ১ এবং পুরাতন কারাগারকে কারাগার-২ হিসেবে নামকরণ করা হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যেই দেশের সকল পুরনো কারাগার কোন অবস্থায় রয়েছে তা জানতে ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে সকল তথ্য জানাতে সকল কারাগারে চিঠি প্রদান করেছি। তথ্য প্রাপ্তির পর আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা ও যাচাই-বাছাই শেষে বাস্তবায়নের কার্যক্রম গ্রহণ করব। কারা বিভাগের জনবল সংকট দীর্ঘদিনের। বর্তমানে অনেক কারাগারে জনবল সংকটের ফলে দায়িত্ব পালনে কারা কর্তৃপক্ষতে হিমশিম খেতে হয় তা সত্ত্বেও এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, প্রাথমিকভাবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জনবলের কিছুটা সমস্যা হলেও আশা করি পরবর্তীতে আস্তে আস্তে তা দূর হয়ে যাবে। বন্দীর স্বার্থ বিবেচনায় ও কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়তে আত্মকর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে পুরনো কারাগার ব্যবহার করা হবে।
×