ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

নন্দিতার ‘মান্টো’ ফুরোয় না

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

নন্দিতার ‘মান্টো’ ফুরোয় না

সাদাত হাসান মান্টো। তাঁকে খুঁজতে গেলে বেরিয়ে পড়ে কাঁটাতারের ভাঙন। সেই ভাঙনের পথ এঁকে দিলেন পরিচালক নন্দিতা দাস তাঁর ‘মান্টো’ ছবিতে। এই মান্টো ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সময়ের। মান্টোর সঙ্গে আসে সে যুগের মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রির গান, কথা আর সংস্কৃতির ছবি। চিত্রনাট্যকার মান্টো তখন জড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে শহরের গায়ে। শহরের অন্ধকার গলি পথের বারবণিতার গন্ধ থেকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল মেহেফিল’-এ তার শায়রানা মেজাজ। নন্দিতার ফ্রেমে মান্টোর তুখোড় ভাবনা, চাঁচাছোলা সংলাপ যেন এক একটা তারা হয়ে জ্বলে। ছবির প্রথম ধাপে মান্টো সংসারী। বউ সফিয়ার জামাকাপড় ইস্ত্রি করে দেওয়া থেকে বান্ধবী ইসমত চুঘতাইয়ের সঙ্গে সখ্য, কোথাও অশোক কুমারের বন্ধুতা। ঝাড়বাতির রোশনাইয়ে ভরা মান্টোর সময়কে দেখতে দেখতে বদলে যায় ক্যানভাস। অভিনেত্রীর শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা যখন সেলুলয়েডে এসে ধরা পড়ে তখন তাঁর গঠনেই থাকে ইতিহাস। চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন নওয়াজ। মান্টোর মধ্য দিয়ে অন্য অনেক মানুষের পারস্পরিক কথোপকথনকে সময়টা বোঝাবার জন্য ব্যবহার করেন নন্দিতা। কী চমৎকারভাবে অনায়াসে চলে আসে জিন্নার কথা। গাঁধী হত্যার ঘটনা। বলতে শোনা যায়, জিন্না নাকি সব মুসলমানকে পাকিস্তানে যেতে বলছেন। হিন্দুরা ভারতে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য! থমকে যান মান্টো। থেমে যায় তাঁর কলম! কী লিখবেন? তাঁর বাবা, মাকে যে দেশে কবরের মধ্যে রাখা হলো সেই দেশ তাঁর নয়? যে শহরের পানওয়ালার কাছে এক টাকার ঋণ রেখে আনন্দে তিনি বলতেন, ‘ওই এক টাকা শোধ দেব না। এ শহরের ঋণ তা হলে শেষ হয়ে যাবে...’ কাঁটাতারের আঁচড় পরে তাঁর কবি মনে। অবশেষে এক দিন বন্ধু, সে সময়ের বলিউডের নায়ক শ্যামের মুখ থেকেও বেরিয়ে আসে মুসলমান বিদ্বেষ। সে দিন ভেতরটা ভাঙচুর হয়ে যায় মান্টোর। পায়ের তলার জমি বদল! স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮-এ দেশভাগের মতোই ভাগ হয়ে গেলেন মান্টো। মুম্বাইয়ের বন্ধুত্ব থেকে লেখা, সব ফেলে লাহৌরে মান্টো। একদম ভাঙাচোরা, কালো মুখ, সঙ্গী মদ। ইসমতের জন্য মন খারাপ কিন্তু তার চিঠি খুলে পড়ে না সে। তখন ভাঙতে ভাঙতে লেখায় যেন তরবারির মেজাজ! ‘ঠা-া গোস্ত’-এর মতো লেখা অশ্লীতার দায়ে আদালতে টেনে নিয়ে যায় তাঁকে। সাহিত্য তো আর অশ্লীল হতে পারে না। সমাজকে তো তা নষ্ট করে দেবে! মান্টোর পাল্টা প্রশ্ন...সাহিত্য নগ্ন হবে না? যেখানে মানুষ রাস্তায় নারীকে ফেলে তাকে শিকার করছে? তার কোলের বাচ্চাকে হত্যা করছে? সাহিত্য সেটা প্রকাশ করবে না? চুপ থাকবে? ১৯৪৮-এর মান্টো নন্দিতার ক্যামেরায় আজকের ঘটনা বলছেন তো! অশ্লীলতাকে ভেঙে চুরমার করলেন মান্টো। এই ভাঙাচোরার ইতিহাস তার আগামী লেখকদের, প্রগ্রেসিভ রাইটারদের দরজা খুলে দিল। এ ছবি দেখতে দেখতে মনে হয় না যে হলে বসে সিনেমা দেখছি। মনে হয়, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি তো নেই! হ্যাঁ, তাঁর চেহারার সঙ্গে মিল আছে এমন এক মানুষকে দেখছি। তিনি মান্টো। কোথায় যেন মিলিয়ে গেছেন নওয়াজ। এ কেবল মান্টো। এমন এক মানুষ যার গল্পের চরিত্র এবং পরিবেশ ভদ্রজনোচিত নয়। অতি অসহ্যরকম নোংরামিতে ভরা। অন্য সাহিত্যিকের মতো মানবজীবনের নান্দনিক ব্যাখ্যা সেখানে অনুপস্থিত। আপত্তিকর শব্দে ভরা... কোথায় সেই লাস্যময়ী রসিকা দুগল? সফিয়ার চরিত্র যেন তাঁর কেরিয়ার জীবনের সেরা অভিনয়। নজর কাড়লেন জাভেদ আখতার, দিব্যা দত্ত, রণবীর শোরে। এত জমাট, ঘন সেপিয়া টোনের আলো জ্বালানো ক্যানভাস বড্ড ঝপ করে তার কালো পরদা টেনে দিল। মনটা খুঁতখুঁত করে। শেষটা এ ছবির শুরুর মতো গোছানো নয়। হয়তো দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া এক মানুষের গল্প কথা এ ভাবেই নিঃশেষ হয়। কিন্তু নন্দিতার মান্টো ফুরোয় না। মান্টোর এপিটাফ তাঁর সাহিত্যের আকাশে আজও অদৃশ্যের মতো আমাদের বলে দিয়ে যায়... এইখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সাদাত হাসান মান্টো। তাঁর সঙ্গে মাটি-চাপা পড়ে আছে ছোটগল্প রচনার যাবতীয় কারুকৃতী আর প্রহেলিকাতাল তাল মাটির নিচে শুয়ে তিনি আপন মনে ভাবছেন, তাঁদের দু’জনের মধ্যে মহত্ত্বর ছোটগল্প লেখক কে : ঈশ্বর না তিনি? সূত্র : আনন্দবাজার
×