ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সংলাপ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৩ জুন ২০১৮

  সংলাপ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন মহল থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ আয়োজনের দাবি জোরালো হচ্ছে। আর এ ইস্যুতে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। তবে বিএনপি মনে করছে নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যাতে এক পর্যায়ে সরকারী দল আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে সংলাপে রাজি হবে। আর আওয়ামী লীগ মনে করছে সংবিধান অনুসারে নির্বাচন করলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোন প্রয়োজন নেই। দুই দলের এই বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালেও দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে অভিজ্ঞ মহল। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে ডিসেম্বরে নির্বাচনের লক্ষ্যে অক্টোবরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সংবিধান অনুসারে অক্টোবরেই অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে আর এ সরকারের আকার ছোট হবে। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের এ অবস্থানের কথা জেনে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিও নড়ে চড়ে বসেছে। বিএনপি অবশ্য অনেক আগে থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংলাপের দাবি জানিয়ে আসছে। তবে বিএনপির এ দাবি আমলে নিচ্ছে না সরকারী দল আওয়ামী লীগ। এ কারণে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখা ঠিক করে রাখলেও তা প্রকাশ করছে না। তবে কিভাবে সরকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসা যায় এ নিয়ে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। আর কোন কারণে সংলাপ না হলে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির কর্মসূচী কি হবে সে বিষয়ে সম্প্রতি লন্ডন গিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শ নিয়ে এসেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মতামতও নেয়া হয়েছে। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, আন্দোলন কর্মসূচী পালনসহ দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে যে সরকারী দল আওয়ামী লীগ সংলাপ করতে বাধ্য হবে। একই দিনে অপর এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সংবিধান অনুসারে। তাই বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন সংলাপের প্রয়োজন নেই। দেশের বড় দুই দলের দুই সিনিয়র নেতার এমন বক্তব্য থেকে পরস্পরবিরোধী অবস্থান সুস্পষ্ট। সূত্র মতে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বেশ কটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন। দেশে ফিরলে মায়ের মতো তাকেও জেলে যেতে হবে। এমন চরম বৈরী পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি যে ভাল ফল আশা করতে পারবে না তা সর্বমহলে আলোচিত। আর এ কারণেই বিএনপি চাচ্ছে সংলাপের মাধ্যমে সরকারী দলের সঙ্গে কিছু বিষয়ে সমঝোতা করতে পারলে নির্বাচনের পরিবেশ কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। বিশেষ করে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা গেলে বিএনপির জন্য ইতিবাচক হবে। অবশ্য বিএনপির একটি অংশ এটাও মনে করছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে দুই দলের মধ্যে সংলাপ করে নির্বাচনে অংশ নিলে তারা অনেকাংশেই লাভবান হতো। তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের দাবি জোরালো থাকলেও বিএনপি সংলাপকে প্রাধান্য না দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকে। আর এতেই আওয়ামী লীগ বিএনপির প্রতি চরম নাখোশ হয়। এখন বিএনপি বার বার সংলাপের কথা বললেও আওয়ামী লীগ তাদের এ কথায় পাত্তা দিচ্ছে না। জানা যায়, আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুসারে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। তারা এখন আর কোনভাবেই বিএনপির সঙ্গে সংলাপে রাজি নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানোর পরও তিনি তা নাকচ করে দেন। এ ছাড়া ২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানাতে চাইলেও তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অনেকক্ষণ গেটে অবস্থান করার পরও গেট খুলে প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়ায় তিনি সেখান থেকে গণভবনে ফিরে যান। তাই এখন যতবারই বিএনপি সংলাপের দাবি জানাচ্ছে আওয়ামী লীগও ততবারই সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে। এদিকে বিএনপি যাতে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ করতে পারে সে জন্য ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সহযোগিতা চায়। এ জন্য বিএনপি নেতারা ঘন ঘন তাদের সঙ্গে বৈঠক করছে। এ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কিছু রাজনীতিককে দিয়ে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। তবে কোন মহল থেকেই এখন পর্যন্ত আশানুরূপ কোন সাড়া পাচ্ছে না ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে থাকা এ দলটি। তবে আশাহত না হয়ে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ’১৩ সালের শেষের দিকে দেশব্যাপী কঠোর আন্দোলনে নামে বিএনপি। বিএনপির এ আন্দোলনে সরাসরি সহযোগিতা করে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও। কিন্তু সহিংস এ আন্দোলনে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ায় দেশ-বিদেশে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি জোট। এক পর্যায়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা করার উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ। খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব দুই দলের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে ফোনালাপ করেন। এ ছাড়া তিনি জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব জর্জ ফার্নান্দেজ তারানকোকে কয়েক দফা বাংলাদেশে পাঠান। তারানকো বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোন সুরাহা করতে পারেননি। দুই দলই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকে। অবশ্য তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপিকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তত দুটি মন্ত্রণালয় নেয়ার। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিএনপিকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপি তাতে রাজি হয়নি। কিন্তু এবার বিএনপি জাতীয় সংসদে না থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অংশ হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিতে চাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দাবি আদায় না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নিলে ভরাডুবি হবে এমন আশঙ্কায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন ৫ শতাধিক ভোট কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করে এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে তারা। এ কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হলেও নির্বাচনের পর সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে না এলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দাপটের সঙ্গেই সরকার পরিচালনা করে। এদিকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে সরকার পতনের জন্য টানা ৯২ দিন লাগাতার অবরোধ কর্মসূচী পালন করে বিএনপি। বাসা ছেড়ে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু সহিংস এ আন্দোলনে পেট্রোল বোমা ও জ্বালাও পোড়াও করে প্রায় দেড় শ’ লোক হত্যা ও কয়েক হাজার যানবাহন পুড়িয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা ধ্বংস করায় এ আন্দোলন নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি আন্দোলন থেকে পিছু হটে। বিএনপির লাগাতার ৯২ দিনের আন্দোলনের পর সরকারও এ দলটির প্রতি কঠোর হয়। এ কারণে এখন পর্যন্ত রাজপথে তেমন কোন কর্মসূচী পালন করতে পারেনি বিএনপি। ছোটখাটো কিছু কর্মসূচী পালন করলেও সেসব কর্মসূচীতে বিএনপি নেতাকর্মীদের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে কারাবন্দী হন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ধারণা করা হয়েছিল খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর বিএনপি রাজপথে দুর্বার আন্দোলন করে দেশের পরিস্থিতি পাল্টে দেবে। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি তারা। দলের নির্বাহী কমিটির প্রায় ৬শ’ নেতার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নেতা নিষ্ক্রিয়। আর দলের অধিকাংশ নেতার নামে রয়েছে বিভিন্ন মামলা। তাই এ পরিস্থিতিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে সরকারী দলের সঙ্গে সংলাপ করে সমঝোতা করা ছাড়া ভাল কিছু আশা করাই অস্বাভাবিক। আর এ কারণেই তারা এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিএনপির সঙ্গে আমাদের সংলাপের প্রয়োজন নেই। কাদের সঙ্গে আমরা সংলাপ করব যারা পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে তাদের সঙ্গে! গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে বিএনপিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত। আর নির্বাচন কিভাবে হবে তা সংবিধানে উল্লেখ আছে। কাজেই সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারকেই সংলাপের আয়োজন করতে হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু করা যায়, কিভাবে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ রাখা যায় তা নিয়ে সংলাপ প্রয়োজন। বিশেষ করে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপ হলে অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব। এতে দেশের গণতন্ত্রও শক্তিশালী হবে। তাই আমরা আশা করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংলাপের আয়োজন করতে হবে।
×