ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নওগাঁয় অধিগ্রহণ ছাড়াই খাল খনন ॥ বিপাকে কৃষক

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

নওগাঁয় অধিগ্রহণ ছাড়াই খাল খনন ॥ বিপাকে কৃষক

বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ ॥ সদর উপজেলার হাঁসাইগাড়ী বিলে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে খান খননের অভিযোগ উঠেছে। জনসাধারণের জমিতে খাল খনন করলেও বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) কোন ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না জমির মালিকদের; এমন অভিযোগ করছে এলাকার কৃষকরা। ফলে কৃষকদের দুঃখ ঘোচাতে গিয়ে ওই খাল এখন কৃষকের চোখের পানিতে ভাসছে। বিএমডিএ নওগাঁ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ভূউপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ সম্প্রসারণ ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের আওতায় সদর উপজেলার হাঁপানিয়া, দুবলহাটী, বলিহার, হাঁসাইগাড়ী, মনসুর বিল, পাকুড়িয়া বিল, নলীর বিল, বারমাসিয়া বিল, হ্যামড়ার বিল ও গুটার বিলের ৩৭ কিলোমিটার খাল পুনর্খনন কাজ শুরু হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। এতে ওই সব বিলের ৬ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতা দূর হবে এবং বোরো মৌসুমে সেচে খালের পানি ব্যবহার করা যাবে। আমন মৌসুমে দ্রুত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ফলে আমন আবাদ করা সম্ভব হবে। খাল খননের গভীরতা ৩ মিটার থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত এবং প্রস্থ সর্বোচ্চ ৪৫ মিটার থেকে ১৬ মিটার পর্যন্ত করা হচ্ছে। ৩৭ কিলোমিটার খাল পুনর্খনন কাজের ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। খাল খননের কাজ ছাড়াও পাঁচটি সাবমার্জড ওয়ারসহ ফুটব্রিজ ও তিনটি পারাপার ড্যাম ক্রসড্রেন করা হচ্ছে। এ কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। সরেজমিন হাঁসাইগাড়ী বিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়নের ভিমপুর, কাঠখৈর ও হাতাস গ্রামের হাইসাইগাড়ী বিলের মধ্য দিয়ে বিএমডিএর খাল পুনর্খনন কাজ চলছে। খাল খননের কোথাও মানদ- (মাটি পরিমাপের ঢিবি বা কাপড়ের নিশানা) চোখে পড়েনি। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, জমি অধিগ্রহণ না করে এবং কোন প্রকার নোটিস ছাড়াই বিএমডিএ জোর করে এই খাল খনন করছে। অনেক কৃষকের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ওপর দিয়ে খাল খনন করা হচ্ছে। অথচ বিলের মধ্যে অনেক খাস জমি থাকলেও সেদিক দিয়ে খাল খনন করা হচ্ছে না। জমির মালিকরা বাধা দিতে গেলে পুলিশের হয়রানির ভয় দেখানো হচ্ছে। ভিমপুর গ্রামের সাইদুর রহমান, শহিদুল ইসলাম, শফির উদ্দিন, আব্দুর রশিদ, হাফিজুর রহমান, কাঠখৈর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, হাতেম আলী, আনিছার রহমানসহ অন্তত ৩০ কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে যেখানে ৪ থেকে ৫ মিটার প্রশস্ত খাল ছিল। সেটা এখন ৩০-৪০ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত করা হচ্ছে। খাস জমি না থাকলেও একই মাপে খাল খনন করা হচ্ছে। ফলে ৫ কাঠা, ১০ কাঠা থেকে শুরু করে কারও দুই-তিন বিঘা পর্যন্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি খালের মধ্যে চলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোন কাজ হয়নি। অনেককে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পরিবর্তে অন্য জায়গায় খাস জমি দিয়ে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বললেও তা বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ভিমপুর গ্রামের কৃষক মোখলেছার রহমান বলেন, হাসাইগাড়ী বিলের মধ্যে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া চার বিঘা জমি আমরা চার ভাই ভোগদখল করে আসছি। এবার আমাদের ওই জমির ওপর দিয়ে খাল খনন করা হয়েছে। আমাদের ২ বিঘা ৫ কাঠা জমি খালের মধ্যে চলে গেছে। বিএমডিএর কাছে অভিযোগ করে এবং জমির কাগজপত্র দেখানোর পরেও তারা জোর করে খাল খনন করেছে। ক্ষতিপূরণ পাব কিনা সেটারও কোন নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। ভিমপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আহমেদ আলী বলেন, দুই বছর আগে একজনের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে ১৮ শতক মাটি কিনে নেই। এবার আমার ওই জমির মধ্য দিয়ে খাল খনন করা হয়েছে। ১৮ শতক জমির পুরোটাই খালের মধ্যে চলে গেছে। ওই জমিতে মাত্র একবার ধান আবাদ করতে পেরেছি। এবারও ধান আবাদ করেছিলাম। কিন্তু খাল কাটা লোকজন সেই ধান কাটারও সুযোগ দেয়নি। ধানসহ জমির মাটি কেটে খাল করেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএমডিএ নওগাঁ কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী ও ওই প্রকল্পের স্থানীয় তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কোন খাল খননেই জমি অধিগ্রহণ করা হয় না। এই খাল খননেও জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। আমার জানা মতে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ওপর দিয়ে কোন খাল খনন করা হয়নি। তবে অনেক ক্ষেত্রে খালের পাড়ের জন্য যে মাটি ফেলা হচ্ছে, সেসব মাটি কৃষকের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে গিয়ে পড়ছে। এরপরেও বেশ কিছু কৃষক আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসছেন। আমরা তাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখছি। অনেক সময় আমরা নিজেরা সার্ভেয়ার নিয়ে গিয়ে কৃষকদের জমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। তিনি বলেন, ওই সব বিলে জমি নিয়ে প্রকৃতপক্ষে অনেক জটিলতা রয়েছে। এই বিলগুলোতে সরকারের প্রায় এক হাজারের বেশি খাস জমি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব জমি সরকারের তত্ত্বাবধানে নেই। অনেক ব্যক্তি সরকারের কাছ থেকে কিছু দিনের জন্য পত্তন নিয়ে সেগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন দাবি করে অন্যের কাছে বিক্রি করেছেন। ওই সব মালিকরা এখন ওই জমি তাদের বলে দাবি করছে। আসলে জমিগুলো খাস। তদন্তে গিয়ে এ ধরনের অনেক প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, খাল খননে কোন প্রকার অনিয়ম হচ্ছে না। এছাড়া কৃষকদের পুলিশের ভয় দেখানো কিংবা কোনভাবে হয়রানি করা হচ্ছে না। জেলা প্রশাসক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ কৃষকরা আমার কাছে করেনি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপরেও কৃষকরা হয়রানি কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে আমি বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।
×