ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

দুর্নীতির রাহুগ্রাসে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

দুর্নীতির রাহুগ্রাসে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতি

দক্ষিণ কোরিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়ে কৌতূহলী যে কোন ব্যক্তির জন্য এখন এক ব্যস্ত সময়। গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সিউলের একটি আদালতে সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন হাইয়ের অফিসে জাতীয় গোয়েন্দ সংস্থা থেকে ৩৮ লাখ ডলার সমমূল্যের অর্থ পাচার করার দায়ে অভিযুক্ত তিনজন সাবেক গোয়েন্দা প্রধানের মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। এক সপ্তাহ পর আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট লা মাইয়ুং বাককে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ, ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি এক কোটি ডলারের বেশি উৎকোচ আদায় করেছিলেন এবং সেই অর্থ একটি লাভজনক অটো পার্টস প্রস্তুতকারী কোম্পানিতে নিজের মালিকানায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। এদিকে গত ৬ এপ্রিল পার্ক গিউন হাইকে শেষ পর্যন্ত ২৪ বছরের কারাদ- ও দেড় কোটি ডলারেরও বেশি জরিমানা করা হেয়েছ। সুতরাং দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক যে চারজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বেঁচে আছেন তাদের সবাই দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন কিংবা দুর্নীতির অভিযোগে তাদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। পার্ক ও লি ছাড়াও চুয়ান দু হুয়ান ও রোহ তায়ে-উ নামে সাবেক যে দু’জন জেনারেল যথাক্রমে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন তারা তাদের সিভিলিয়ান উত্তরসূরি কিম ইয়ং স্যামের আমলে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। অভিযোগ ছিল তারা দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী চায়িবলের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করেছিলেন। এ ছাড়া লোকান্তরিত তিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির কেলেঙ্কারি ছিল। কিম ইয়ং স্যাম ও কিম দায়ে জুং দু’জনেই দুর্নীতির মূলোৎপাটনের অঙ্গীকার করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তারা লক্ষ্য করেন যে তাদের পুত্ররা প্রভাব খাটানোর কারবারে জড়িয়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। কিম দায়ে জুংয়ের পর ক্ষমতায় আসেন রোহ মুন হাইয়ুন। ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার এক বছর পর তিনি আত্মহত্যা করেন। অভিযোগ ছিল তিনি উৎকোচ গ্রহণ করে স্ত্রী ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে পাচার করেছিলেন। অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে দুর্নীতি আকস্মিক কোন ঘটনা নয় বরং দীর্ঘদিনের বৈশিষ্ট্য। সিউলের এক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের ভাষায় ‘এই সেদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক আনুকূল্যের বিনিময়ে চায়িবল’-এর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্থ চাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হতো।’ এর জন্য দেশের স্বৈরাচারী অতীতই দায়ী বলে তিনি মনে করেন। তার মতে গণতন্ত্রের রোধন ও সমন্বয় ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণেই রাজনীতিকরা রাষ্ট্র্রের স্বার্থের সঙ্গে নিজদের স্বার্থকে গুলিয়ে ফেলেন। হয়ত সে জন্যই মিজ পার্ক তার বিচারের সময় এমন উদ্ভট আচরণ করেছেন। প্রসিকিউটরদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাননি। এমনকি শুনানিতে হাজির পর্যন্ত হননি, যার ফলে মামলায় তার অবস্থান আরও খারাপ হয়েছে। তার আচরণে মনে হয়েছে যে কৃতকর্মের জন্য তার মধ্যে কোন অপরাধবোধ নেই গত মার্চে লি মাইয়ুং-বাকও তার বিচারের সময় প্রসিকিউটরদের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিচার বিভাগের প্রতি একই রকম অবমাননা প্রদর্শন করেন। তবে মিজ পার্কের আগে কোন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেই ক্ষমতায় থাকাকালে এত ব্যাপক তদন্ত হয়নি। প্রেসিডেন্ট আদালত ও প্রসিকিউটর অফিসগুলোতে তার কৃপা প্রার্থীদের বসিয়ে দিয়ে নিজের কার্যকলাপ খতিয়ে দেখার বিষয়টি খর্ব করতে পারতেন। সরকার যা চায় তা মেনে চলার একটা প্রবণতা বিচারক ও প্রসিকিউটরদের মধ্যে কাজ করত। এ কারণে রুই- কাতলাদের খুব বেশি আশঙ্কা করার কারণ থাকত না। সমীক্ষায় দেখা গেছে উচ্চ ক্ষমতাধর আসামিদের শাস্তি হতো অপেক্ষাকৃত ছোট। ক্ষমা করে দেয়ার ঘটনাও সচরাচর লক্ষ্য করা যেত কিন্তু এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বিচার বিভাগ নিজের কর্তৃত্ব স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারছে যার ফলে তারা বর্তমান ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কাউকেই রেহাই দিচ্ছেন না। কিন্তু অনেক দক্ষিণ কোরীয় মনে করেন যে দু’চারজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে শাস্তি দেয়াই যথেষ্ট নয়। কাঠগড়ায় এদের দাঁড় করানো মানেই রাজনীতির গোটা ব্যবস্থাকে দাঁড় করিয়ে দেয়া। চার-পঞ্চমাংশ নাগরিক বিশ্বাস করে যে রাজনৈতিক স্বচ্ছতার উন্নতি সুষম ও সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তোলার পূর্বশর্ত। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×