ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

হাশেম খান এক সৃজনশীল মানুষ

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৮

হাশেম খান এক সৃজনশীল মানুষ

রং-তুলিতেই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি তার নিজের পরিচয়। রেখেছেন সৃজনশীলতার অনন্য স্বাক্ষর। শিল্পকলায় নিমগ্ন শিল্পী হাশেম খান ৭৬ পূর্ণ করে আজ ১৬ এপ্রিল পা দিয়েছেন ৭৭-এ। সৃষ্টিশীল এই মানুষটি তার সৃজনশীল কর্মপ্রবাহে সমৃদ্ধ করে চলছেন চারুকলা। ১৯৪২ সালের এই দিনে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সেকদী গ্রামে এক সভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তৎকালীন কুমিল্লা জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউসুফ খান ও মা (গৃহিণী ) নূরেন্নেসা খানমের ১৪টি সন্তানের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। ১৯৬৯ সালে কুমিল্লার ব্রাক্ষণবাড়িয়ার পারভীন হককে বিয়ে করেন তিনি। এ দম্পতি কনক খান ও শান্তনু খান নামে এক কন্যা এবং এক পুত্র সন্তানের জনক-জননী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খ্যাতিমান এই শিল্পী দীর্ঘ ৬১ বছর ধরে শিল্পচর্চায় ও সংস্কৃতিবিকাশে নিয়োজিত। ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চারুকলা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করেছেন। দেশের চারুকলা বিকাশের আন্দোলনে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টিতে তিনি নিবেদিতপ্রাণ। তরুণ বয়সে তিনি কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উপদেশ ও সহযোগিতায় শিশু চিত্রকলাকে সংস্কৃতি চর্চার বিষয় হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করেন। আজ শিশু চিত্রকলা বাংলাদেশে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। তিনি এই ধারার পথিকৃৎ। হাশেম খান ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। তিনি ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও প্রগতিশীল রাজনীতির প্রায় সব পোস্টার, ফেস্টুন, ছবি, প্রচার পুস্তিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন। ১৯৬৬ সালে বাঙালীর মুক্তি সনদ ঐতিহাসিক ছয়-দফার লোগো, পতাকা নকশা, পোস্টার ও অন্যান্য শিল্পকর্ম করেছেন শিল্পী হাশেম খান। ছয় দফা সর্বপ্রথম জনগণের সম্মুখে ঘোষণার জন্য তৎকালীন হোটেল ইডেনের সামনে যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল তার ‘ব্যাকসিনে’ ছয় দফার প্রতীকী নকশা দিয়ে সাজিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে যে ঐতিহাসিক পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিলÑ তা এঁকেছিলেন শিল্পী হাশেম খান। বাংলাদেশের সংবিধান গ্রন্থটির শিল্পমান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৭৩ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শিল্পাচার্য তাঁর প্রিয়ভাজন শিল্পী হাশেম খানকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। রুমে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আবেদিন ভাই আসুন।’ তারপর দু’জনে করমর্দন করলেন। শিল্পাচার্য তার প্রিয় ছাত্র হাশেম খানকে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধু মাঝখানে শিল্পাচার্যকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আবেদিন ভাই, আপনি বসুন, আমিই ওর পরিচয় দিচ্ছি। ও আমার ছয় দফার মনোগ্রাম, নকশা, পোস্টার করেছিল। ছয় দফা ঘোষণার জন্য যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল তার ভ্যাকসিনটা ও এত সুন্দরভাবে করেছিল আমার এখনও সব মনে আছে। ছয় রং, ছয়টি গঠন ও আকৃতি ইত্যাদি দিয়ে সেদিন ছয় দফার যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল আমি আগে ভাবতেই পারিনি আমার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ও বাঙালীদের নায্য অধিকারসহ নকশা, ছবি দিয়ে ছয় দফার এত চমৎকার ব্যাখ্যা হয়। বাংলার মানুষের জীবনযাপন এবং চিন্তা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হয় ছয় ঋতু দিয়ে। আমার রাজনৈতিক ছয় দফা এবং বাংলার মানুষের জীবনের ছয় ঋতুকে সে একীভূত করে ছয় দফার অপূর্ব নকশা করেছিল। আবেদিন ভাই, সংবিধান গ্রন্থে ছবি আঁকার জন্য আপনি ঠিক লোককেই পছন্দ করেছেন।’ বাংলাদেশের ‘সংবিধান গ্রন্থের’ প্রতি পৃষ্ঠায় চারদিক জুড়ে রয়েছে নকশা এবং ভেতরে লেখা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তত্ত্বাবধানে প্রধান সহযোগী শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন শিল্পী হাশেম খান। নকশা তৈরি করেছেন জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। লিপিকার ছিলেন আব্দুর রউফ। বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক প্রায় ৩০০ ছবির একটি এ্যালবামের তিনি নির্বাহী সম্পাদক। ওই এ্যালবামের সম্পাদকম-লীর সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। যা ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু গ্রন্থমালা’ সিরিজের সম্পাদকীয় বোর্ডের তিনি সভাপতি। এই সিরিজে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বই ও ছবির এ্যালবাম মিলে মোট ২৫টি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিল্পী হাশেম খান এখন প্রতিষ্ঠানটির কর্মপরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিল্প কর্মে অসামান্য অবদানের জন্যে তিনি ১৯৯২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়াও তিনি দেশী এবং আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য ১৬ বার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন। ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলো মনোনীত করে। ৩ বার অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একজন সুলেখকও। এ যাবত তার প্রকাশিত গ্রন্থ ২০টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো : গুলিবিদ্ধ ‘৭১, স্বাধীনতা ও জরিনারা, চারুকলা পাঠ, নিরাবরণ কন্যার গল্প অল্প, জয়নুল গল্প ও জয়নুলের সারাজীবন, কটিক এবং মধুবক। পাবলো পিকাসো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভিনসেন্ট ভ্যান গগ প্রমুখ কিংবদন্তি চিত্রশিল্পীর জীবন ইতিহাস বলে, শিল্পীরা হলেন তেমন চেতনাঋদ্ধ মানুষ যারা আঁধারেও স্বপ্ন দেখেন, মুক্তির কথা ভাবেন। সেই জন্যেই ভেতরের অর্গল খুলে সৃজন উল্লাসে মগ্ন হন। শিল্পী হাশেম খান এর ব্যতিক্রম নন। তার তুলিতে মানুষ, মানুষের অধিকার, প্রকৃতি এবং দেশের কথা উঠে আসে। আজ তাঁর ৭৭তম জন্মদিনে আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×