ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এখন ফেরি করে সংসার চলে

দশ বছর বয়সেই নাক দিয়ে বাঁশি বাজানো শুরু মোখলেছের

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২৪ মার্চ ২০১৮

 দশ বছর বয়সেই নাক দিয়ে বাঁশি বাজানো শুরু মোখলেছের

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ সকাল থেকে বাঁশি ফেরি করে বেড়ান মোখলেছ হোসেন। পাশাপাশি তার বাঁশির সুরে শ্রোতা ও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেন তিনি। তবে মোখলেছ অন্যান্য বাঁশিওয়ালার থেকে ভিন্ন কায়দায় বাঁশি বাজিয়ে উৎসুক জনতাকে আকৃষ্ট করেন। কারণ তিনি নাক দিয়ে ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, লালনসহ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর তোলেন। ভিন্ন কায়দায় বাঁশি বাজানোর জন্য সহজেই শ্রোতাদের মন জয় করেন তিনি। বাঁশি বিক্রি করে কিছু আয় হয় তার। তাই দিয়ে সংসার চলে। একটা বাঁশি বিক্রি হলে মনে স্বস্তি আসে তার। কখনও বসে আবার কখনও দাঁড়িয়ে ফেরি করে চলা ৫৫ বছর বয়সেও কোন ক্লান্তির ছাপ নেই মোখলেছের শরীরে। আছে সংসারের দায়িত্ব। আর তাই তো ২০ বছর ধরে এই অল্প রোজগারেই পরিবার চালানোর পাশাপাশি সন্তানদের পড়ালেখা শেখাচ্ছেন। মোখলেছের নাক দিয়ে বাঁশি বাজানোর শুরুটা ১০ বছর বয়সেই। এরপর থেকেই বাঁশিতে নিত্যনতুন সুর তুলতে থাকেন তিনি। তবে পরিবার বা আত্মীয়-স্বজন এমনকি স্কুলের শিক্ষকরাও তার এই প্রতিভার বিষয়টি সবসময় উপেক্ষা করেছেন বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন মোখলেছ। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘বাড়িতে বাঁশি বাজালে আব্বা বকা দিত এমনকি মারত। আবার স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের বাঁশি বাজিয়ে শোনালে স্যারও বকা দিতেন। আমি কারও কাছ থেকেই উৎসাহ পাইনি। এজন্যই পড়ালেখা ছেড়ে দিলাম। কারণ বাঁশি বাজানোর পেছনেই আমি বেশি সময় পার করতাম। পড়ালেখা করব কখন! তারপর ভাবলাম বাঁশি বিক্রি করলে কিছু রোজগারও হবে আর আমি মনের আনন্দে বাঁশি বাজাতেও পারব। এরপর আমার নেশাকে পেশা হিসেবে নিলাম।’ শরিয়তপুর জেলায় মোখলেছের জন্মভিটা। তিন বছর আগে রাজধানীতে পরিবারসহ পাড়ি জমান একটু বেশি রোজগারের আশায়। বর্তমানে তিন মেয়ে ও ছোট ছেলেকে নিয়ে বাবুবাজারে এক ভাড়া বাসায় থাকেন এই বাঁশিওয়ালা। তার মোট ছয় সন্তান। বড় ও মেজো ছেলেটি গ্রামে থাকে বলে জানালেন মোখলেছ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বড় ছেলেটি এবার ক্লাস নাইনে। জেএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে। মেজোটা সেভেনে পড়ে। মেয়েরাও লেখাপড়া করছে। আমার যত কষ্টই হোক ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শেখাতে চাই। কারণ আমি বাঁশির নেশায় নাইনের পর আর পড়ালেখা করিনি।’ সংসারের বোঝা টানতে যেন কোন বাধাই মোখলেছের কাছে বাধা নয়। বাঁশির ওপরই ভরসা করে সংসারের সবাইকে নিয়ে ভাল থাকার স্বপ্ন দেখেন এই মানুষটি। রাজধানীতে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ সম্পর্কে মোখলেছ বলেন, ‘শরিয়তপুরে নিজ জেলা-উপজেলাসহ রাস্তাঘাট সবই আমার পরিচিত জায়গা। একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে আর বাঁশি বিক্রি হতো না। সংসার চালাতে পারতাম না। ঢাকায় অনেক জায়গা আছে। আজ শাহবাগ, কাল গুলিস্তান, পরশু চন্দ্রিমা উদ্যান এভাবেই একেক দিন একেক জায়গায় বেড়াই। আর বেঁচা-বিক্রিও এলাকার চেয়ে দ্বিগুণ।’ মোখলেছ বলেন, কিছু মানুষ আছে, যারা বাঁশের বাঁশির সুর ভালবাসেন। তারা আমার বাঁশির সুরে বিমোহিত হয়ে বাঁশি কিনেন। তবে সংস্কৃতি অনুরাগীদের পাশাপাশি কিছু মানুষ সৌখিন রয়েছে যারা বাঁশি বাজাতে না পারলেও বাঁশি কিনে নেন। এরাই আমার ব্যবসার ভরসা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রায় পনেরো শ’ থেকে দুই হাজার টাকার বাঁশি বিক্রি করেন। সেইসঙ্গে অনেকেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে কখনও এক শ’ আবার কখনও দুই শ’ যে যেমন পারে দেয় বলে জানান তিনি। হরেক রকমের বাঁশি ভর্তি ব্যাগ থেকে ছোট-বড়-মাঝারি সাইজের বাঁশি বের করে সুর তোলেন মোখলেছ। তিন রকমের বাঁশি বিক্রি করেন তিনি। আড়বাঁশি, মোহনবাঁশি ও মুখবাঁশি। তবে আড়বাঁশি বাজিয়ে লোক জড়ো করেন। অথবা বাঁশি বাজাতে বাজাতেই পথ চলতে থাকেন। যার প্রয়োজন তিনি ডেকে তার কাছ থেকে বাঁশি কেনেন। তার বাঁশির সুরে কখনও কখনও ভেসে আসে মাটির সুর। কখনও পল্লীগীতি কখনও ভাটিয়ালি। তবে সব ধরনের গানের সুরই তিনি বাঁশি নাকে বাঁধিয়ে তুলতে পারেন। মোখলেছের কাছে ৩০ টাকা থেকে এক শ’ ৬০ টাকা মূল্যের বাঁশি রয়েছে বলে জানান। মোখলেছের কাছে কখনও কোন ক্রেতা অর্ডার দিলে তিনি উন্নতমানের বাঁশের বাঁশি এনে দেন। দু’এক মাস পর পর আখাউড়া বর্ডার এলাকা থেকে মোখলেছ বাঁশি কিনে আনেন। ভবিষ্যতে নিজ উদ্যোগে একটি বাঁশির দোকান দিয়ে ব্যবসা করতে চান মোখলেছ। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘বয়স হচ্ছে এভাবে আর রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো সম্ভব না। অনেক শখ ছিল গানের দলে বাঁশি বাজাব। কিন্তু সুযোগ পায়নি। তবে কারও কাছ থেকে সাহায্য পেলে হয়ত একটি দোকান গড়তে পারতাম। তাহলে অন্তত সন্তানদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত হতো।’
×