ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কেটে গেল বিনিদ্র রাত

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ৪ জানুয়ারি ২০১৮

কেটে গেল বিনিদ্র রাত

সব্যসাচী দাশ আমাদের পরিষ্কার মনে আছে যখন টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় খবর হলো, ২০১৭ সালে ঢাকায় বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব অনুষ্ঠিত হবে না। তখন এই খবর শোনাতে আমরা কতটা মনোক্ষুণœ হয়েছিলাম তার জ্যান্ত উদাহরণ এখনও বর্তমান! বিশেষ করে, অনেকের কথা-বার্তায় বা সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমের উদ্ধৃতিগুলো ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। গত পাঁচ বছর ধরে যারা এই উৎসবে গিয়েছেন এবং আত্মনিমগ্ন হয়ে বিনিন্দ্র রাত কাটিয়েছেন তাদের কয়েকজনের কথা উল্লেখ করা যাক। জতিশ চন্দ্র ম-ল। জীবনের প্রয়োজনে পরিবার থেকে দূরে রাজধানী শহর ঢাকা থাকেন। ছোট-খাটো গায়খাটা একটা চাকরি করে জীবন টানছেন, কোটি কোটি এই মানুষের শহরে। কিন্তু, রুচিত জতিশ ম-ল একটুখানি সংস্কৃতিমনা। তার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়। মনোরঞ্জনের জন্য প্রাণের তাগিত তাকে কতটা এই সেক্টর আকর্ষিত করে। উৎসবের গত পাঁচটা আসরে তার উপস্থিতি ছিল সেতার, সরোদ, বাঁশি, সারেঙ্গি, বীণার মতো আরও কিছু যন্ত্রের মহোনীয় মাতাল সুরে মুগ্ধ হয়ে নির্ঘুম রাত্রি শেষ করে, কাক ডাকা কুয়াশামাখা ভোরে বাসায় ফেরার অভিজ্ঞতা। কথা প্রসঙ্গে তার কাছে জানতে চয়েছিলাম, সঙ্গীতের এই উচ্চমার্গীয় খেয়াল, রাগ কিংবা রসুই এসবের কিছু বোঝেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেন, এসবের নাম আমি শুনেছি কিন্তু মর্মার্থ আমি বুঝি না। সেতার, সারদ কিংবা বাঁশির সুর আমায় ভীষণ শান্তি দেয়! কি যে শান্তি পরশ! কাউকেই ঠিক ঠিক বোঝাতে পারব না! প্রথম যখন শুনলাম এবারের উৎসব হচ্ছে না তখন ভীষণভাবে মন খারপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাস খানেক পর যখন জানলাম স্থান পরির্বতন করে বাড়ির আরও কাছে অর্থাৎ ধানম-ির আবাহনী মাঠে অনুষ্ঠিত হবে এবারের উৎসব। তখন, মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। সাফ্ওয়না জাবিন পেশায় একজন গৃহিণী হলেও মনেপ্রাণে একজন সংস্কৃতি কর্মী। নিজেদের কাছের কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন ‘স্বরূপ সাংস্কৃতিক সংসদ’ নামে একটি সংগঠন। প্রতিবছর সংগঠনের সদস্য এবং পরিজন নিয়ে রাতভর উপভোগ করেন উচ্চঙ্গসঙ্গীতের এই চমৎকার উৎসব। উৎসব শেষে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সবাইকে নিয়ে কেমন উপভোগ করলেন এবারের উৎসব? তিনি বলেন, প্রথম যখন শুনেছিলাম এবারের উৎসব অনুষ্ঠিত হবে না। তখন কিন্তু, ভীষণ হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর যখন গত ২৬ ডিসেম্বর পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়ির কাছে উৎসবস্থলে উপস্থিত হলাম তখন, শুরুতেই প্রাণের ভেতর এক শীতল সুখ অনুভব করলাম। কিছুক্ষণের ভেতর নিজের অজান্তে কোথায় যে হারিয়ে গেলাম নিজেও জানি না। এভাবেই সবার সঙ্গে গত কয়েকটা রাত ছিল আমাদের স্বপ্নীল! আমি, আমার পরিবার বন্ধুবান্ধবসহ পরিচিত আরও অনেকেই বছরের এই সময়টায় বেঙ্গলের আয়োজিত এই মহোৎসবের অপেক্ষায় থাকি। গত পাঁচবারের মতো এবারেও ঢাকায় ষষ্ঠ বারের মতো অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ২০১৭। আবুল খায়ের লিটুর উদ্যোগে ২০১২ সাল থেকে এই সঙ্গীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সর্বভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওস্তাদ, গায়ক, বাজিয়ে ও নৃত্যশিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনে ঢাকা তথা বাংলাদেশীদের চমৎকৃত করে আসছেন উৎসবে অংশ নেয়া পুরোধারা। দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা বিচারে এই উৎসব এখন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উৎসবে পরিণত হয়েছে! গত পাঁচ বছর ধরে উৎসবটি আয়োজিত হয়ে আসছিল বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। নবেম্বরের শেষে। এ বছর কেন জানি ওই ভেন্যুটি আর মেলেনি। তারপরও অগণিত প্রাণের আকুতিতে অবশেষে অনুষ্ঠিত হলো এই উৎসব। পঞ্চমরারের মতো এবারেও সঙ্গীত উৎসবের শব্দ ও ভিডিও ব্যবস্থাপনা ছিল চমৎকার। এবারের আসরে খেয়াল স¤্রাট ওস্তাদ রশিদ খান এবং সুপ্রিয়া দাশের গাওয়া খেয়াল , মণিপুরি, ভরতনাট্যম ও কথুক এর নৃত্য। রনু মজুমদার আর রাকেশ চৌরাশিয়ার বাঁশি, তেজেন্দ্রনারায়ণের সারোদ, বিশ্বমোহন ভাটের মোহনবীণাবাদনের খেয়াল এছাড়া প-িত কৈবল্য কুমার, ব্রজেশ্বও মুখোপাধ্যায়, তবলাশিল্পী শুভেন চট্টোপাধ্যায়, প-িত যশরাজ সাসকিয়া রাও প্রমুখ গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ শেষ রাত পর্যন্ত শীত কাতুরে এই পৌষালি রাতে জতিশ ম-ল, সাফ্য়াওনা জাবিনদের মতো অসংখ্য সঙ্গীত অনুরাগী নামকরা সব ওস্তাদের বিভিন্ন খেয়ালে হৃদয় পুরিয়েছেন। অর্থ সম্পদে বলিয়ান পৃথিবীর অনেক বড় বড় দেশ যেখানে এমন উৎসব আয়োজন তো দূরের কথা শ্রোতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। সেখানে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত গরিব দেশে এমন আয়োজন সত্যই অতুলনীয়। সঙ্গীত সাধনা কিংবা শিল্প সাধনায় যারা জীবনপুণ্য করতে চান তাদের মতো বিশুদ্ধ আনুরাগীর জন্য এই উৎসব এক রকম অমৃতসুধা।
×