ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফেরত নাও অধিকার দাও

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

ফেরত নাও অধিকার দাও

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিদেশী ত্রাণকর্মীদের ঢুকতে অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আনা জাতিসংঘ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে চীন ও রাশিয়া। এই প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সব শরণার্থীর প্রত্যাবাসন নিশ্চিত এবং তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। গার্ডিয়ান। জাতিসংঘ মিয়ানমারের প্রতি জাতিগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টার্গেট করে শুরু করা সামরিক দমনাভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। চীন, রাশিয়া ও আঞ্চলিক দেশগুলোর বাধা উপেক্ষা করে সেখানে একজন জাতিসংঘের বিশেষ দূত নিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। ওআইসির আহ্বানে আনা প্রস্তাবটি ১২২-১০ ভোটে পাস হয়। ২৪ দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। চীন, রাশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, বেলারুশ, সিরিয়া ও জিম্বাবুইয়ে ভোটদানে বিরত থাকে। এই প্রস্তাবে সব রোহিঙ্গা শরণার্থী যেন নিরাপদে দেশে ফিরতে পারে এবং তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেয়া হয় সে লক্ষ্যে ত্রাণকর্মীদের সেখানে ঢোকার অনুমতি দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। এতে মিয়ানমারে জাতিসংঘের একজন বিশেষ দূত নিয়োগ দেয়ার জন্য মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে। বাজেট কমিটিতে প্রস্তাবটি পাস হওয়ায় সেটি সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়। মিয়ানমারে জাতিসংঘের একজন বিশেষ দূতের পদ তৈরির বিষয়টি প্রাথমিকভাবে বাজেট কমিটি অনুমোদন করে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আগস্টে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে সামরিক দমনাভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় লাখের বেশি শরণার্থী বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা জঙ্গীবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো দমনাভিযানকে জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে অভিহিত করেছে। গত সপ্তাহে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘি লিকে মিয়ানমারে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারও তার সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন শুরুর প্রথম চার সপ্তাহেই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ৬ হাজার ৭ শ’ জনকে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ৭৩০ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। যুক্তরাষ্ট্রও রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শুরু করা গণহত্যা ও নিপীড়নকে জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে আনুমানিক ৬ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চরম অমানবিক ব্যবহারের ঘটনায় বিভিন্ন দেশে মিয়ানমার ও এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী আউং সান সুচির নিন্দা করে। জীবন ভয়ে ভীত আশ্রিত রোহিঙ্গারা মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ চট্টগ্রাম/ কক্সবাজার থেকে জানান, প্রত্যাবাসিত হলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন ও বেঁচে থাকার প্রশ্নে শঙ্কামুক্ত হচ্ছে না। আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার পরিকল্পনা নেয়া হলেও রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা আগমন কোনভাবেই থামছে না। সোমবার সকালে ৫৬ রোহিঙ্গার নতুন অনুুপ্রবেশ ঘটেছে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কসংলগ্ন পয়েন্ট দিয়ে। রাতের আঁধারে নৌকাযোগে এরা মংডু থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছে। নৌকার মাঝি মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে তাদের নামিয়ে দিয়ে শটকে পড়ে। সকালে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন উখিয়া-টেকনাফের আওয়ামী লীগদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদি। মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে জড়ো হয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের দেখে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাৎক্ষণিক দুটি জীপ ভাড়া করে তাদের হারিয়াখালী সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। নতুন আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, রাখাইনে যে খাদ্যাভাব চলছে তাতে কোন উন্নতি নেই। মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে তাতে আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। তাদের মতে বিশ্বকে দেখানোর জন্য তারা হয়তা রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু অধিকাংশের ভাগ্য বিড়ম্বনায় থাকতে হবে। আর সেখানে ফিরে গেলেও তাদের রাখা হবে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় শরণার্থী ক্যাম্পে। রাজ্যের তাওংপিওয়ো লেটওয়ে গ্রামে। গ্রামটির সন্নিহিত এলাকায় রয়েছে পুলিশের একটি চেকপোস্ট। চেকপোস্টের পাশে রোহিঙ্গাদের জন্য দুটি ব্যারাক নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা নিশ্চিতভাবে ধারণা করছে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হলেও নিজ বাড়িঘরে স্থান হবে না। নাগরিকত্ব নেই, চলাফেরার অবাধ সুযোগ-সুবিধা নেই, তার ওপর নিজেদের বসতিও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণে তাদের মধ্যে যাদের নেয়া হবে তাদের ব্যারাকবাসী হিসেবেই জীবনযাপন করতে হবে। যেখানে বেঁচে থাকতে হবে সীমিত খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে। নিজ দেশে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে থাকতে তাদের প্রচ- অনীহা রয়েছে। ফলশ্রুতিতে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের মাঝে আগ্রহ বা কোন উদ্দীপনা নেই। এদিকে, উখিয়া-টেকনাফের যত্রতত্র ঝুপড়ি নির্মাণ করে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় স্থলে এনে শৃঙ্খলায় রাখার কাজ শুরু হয়েছে। টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে কিছু ঝুপড়ি ইতোমধ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব ঝুপড়ি থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উখিয়া-টেকনাফে নতুন-পুরনো মিলিয়ে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা স্থানীয়দের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে অনাকাক্সিক্ষত ছোট ছোট বহু ঘটনা ঘটে গেছে। অনগ্রসর পরিবেশে থেকে রোহিঙ্গাদের মাঝে সভ্যতার কোন ছোঁয়া না লাগায় এরা আইন-কানুন বা প্রশাসনের রীতিনীতির প্রতি তোয়াক্কা না করে চলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের লোকজন দিন গুনছে কখন তারা রোহিঙ্গা মুক্ত হবে। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নিকারুজ্জামান জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সরকারের সঙ্গে মিয়ানমারের সমঝোতা স্মারক হয়েছে, গঠিত হয়েছে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি। আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে প্রত্যাবাসন শুরু করার টার্গেট রয়েছে। সে অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন যাবতীয় কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন নতুন রোহিঙ্গার আগমন প্রশাসনকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, রাখাইনে তারা এখনও নিরাপদ নয়। বাংলাদেশে যারা পালিয়ে এসেছে তারা নিরাপদে রয়েছে এমন খবর জোরালোভাবে প্রচার হওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে পালিয়ে আসা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশে আশ্রয়ের পাশাপাশি ত্রাণসামগ্রীর কোন অভাব নেই। খাদ্যের কোন সঙ্কট নেই। অপরদিকে, রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাদের জন্য এখনও নিরাপদ হয়নি। মিয়ানমার সরকার দশকের পর দশকজুড়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে। বর্তমানে সেনা অভিযান গুটিয়ে ফেলা হলেও পুলিশ ও সেখানকার স্থানীয় মগ সন্ত্রাসীদের উৎপাত বন্ধ হচ্ছে না। ফলে সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এখনও নিজেদের নিরাপদ মনে করছে না। আর এ মনে না করার কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা অসহায় তারা বাংলাদেশে চলে আসার পথ বেছে নিচ্ছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে যে সম্মতি দিয়েছে তাতে তাদের আন্তরিকতা নেই। বিশ্ব চাপের মুখে অনেকটা নতি স্বীকার করে আউং সান সুচির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি পরিমাণ রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেবে তা নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আগামী ২৩ জানুয়ারির আগে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করার কথা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ কাজে যত না প্রস্তুত মিয়ানমার অনেকাংশে ততটা ম্রিয়মাণ। মূলত মিয়ানমার সরকার, সামরিক জান্তা ও সেখানকার উগ্র মগ জাতির সদস্যরা রোহিঙ্গাদের কোনভাবে সহ্য করে না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের মাঝে বড় ধরনের ভীতি রয়েছে। মিয়ানমার সরকার তার বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলে যেমন তৎপর তেমনি রাখাইন রাজ্যে রাখাইনরা সেখানে রোহিঙ্গাদের অবস্থান থাকুক তা তারা চাই না। এছাড়া রোহিঙ্গাদের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ। যারা নিজেদের অধিকার আন্দোলনে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। কখনও কখনও এ সংগ্রাম সশস্ত্র রূপও নিয়ে থাকে। ফলে সার্বিকভাবে রোহিঙ্গারা সেখানে থাকুক, বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রিতরা পুনরায় ফিরে যাক, তা তারা মনেপ্রাণে চায় না। মূলত এসব কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে মিয়ানমার সরকারের ইঙ্গিতে সে দেশের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) কোন ধরনের বাধা প্রদান করছে না। কিন্তু যেকোন পথে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে তৎপর। অপরদিকে, যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে এদের অধিকাংশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। যেসব বাড়ি-ঘরের অস্তিত্ব রয়েছে তাও লুটেরাদের কবলে পড়ে ছারখার হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের বসতিগুলোর চিহ্ন মুছে ফেলতে ইতোমধ্যে বুলডোজার দিয়ে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত যে দশটি গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে এর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে।
×