ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তিন কর্মকর্তাকে উপদেষ্টা নিয়োগে অপকৌশল, আন্ডারগ্রাউন্ড দৈনিকে বিজ্ঞাপন

রিটায়ারমেন্ট আইনের তোয়াক্কা নেই বিজেএমসির

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

রিটায়ারমেন্ট আইনের তোয়াক্কা নেই বিজেএমসির

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সরকারের পাবলিক সার্ভেন্টস রিটায়ারমেন্ট আইন মানছে না বাংলাদেশ পাট কল কর্পোরেশন (বিজেএমসি)। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ (পিআরএল) ভোগরত তিন কর্মকর্তাকে বিজেএমসির পরিচালকের নির্বাহী ক্ষমতা প্রদানপূর্বক আইনবহির্ভূতভাবে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোন প্রকার অনুমোদন না নিয়েই এ নিয়োগ প্রদানের ফলে শুধু সরকারী বিধানটি চরমভাবে লঙ্ঘিতই হয়নি, সরকারের আর্থিক ক্ষতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটছে। এই তিন কর্মকর্তা হলেন এ কে নাজমুজ্জামান (২৩২৭), মোঃ সিরাজুল ইসলাম (৩৪৩৮) এবং বাবুল চন্দ্র রায় (৩৬১৪)। এদের মধ্যে নাজমুজ্জামান ২০১৪ সালের ৫ মার্চ বিজেএমসিতে যোগ দেন এবং ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যান। সিরাজুল ইসলাম যোগ দেন ২০১৪ সালের ৯ অক্টোবর এবং অবসরে যান ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর। অন্যদিকে, বাবুল চন্দ্র রায় যোগ দেন ২০১৪ সালের ৫ মার্চ এবং অবসরে যান ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি। কর্মকর্তাত্রয়ের অবসর গ্রহণের সময় সমাগত হওয়ায় নিয়মানুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের প্রেষণ আদেশ বাতিলপূর্বক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করে। তারা যথারীতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগদানও করেন। পরবর্তীতে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের পিআরএল আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু কোন এক রহস্যজনক কারণে গণকর্মচারী অবসর বিধিমালা ভঙ্গ করে ওই তিন কর্মকর্তা পিআরএলে যাওয়ার পরও বিজেএমসি থেকে সকল সুবিধা গ্রহণ অব্যাহত রেখে পরিচালক হিসেবে অবৈধভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মকর্তাগণ বিজেএমসিতে থাকাকালীন দাফতরিক প্রয়োজনে সকল দেশী ও বিদেশী স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান। তাই পিআরএল সমাগত হওয়ার পর পরই মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির কতিপয় কর্মকর্তা তাদের পারস্পরিক প্রয়োজনে কর্মকর্তাত্রয়কে পরিচালক পদে বহাল রেখে এক্সটেনশন দিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদানের অপচেষ্টা শুরু করে। একই সময়ে মোঃ ফেরদৌস আলম (৩৬৬৭), মোহাম্মদ শমসের আলি (৩৪৯৬) এবং আরও এক কর্মকর্তাকে প্রেষণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশবলে বিজেএমসির পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বিজেএমসির পক্ষ থেকে তাদের কোন দায়িত্ব দেয়া হয়নি। ওই তিন কর্মকর্তা সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের বিধায় তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারাধীন। কিন্তু বিধি মোতাবেক এক্সেটনশন মঞ্জুর হবে না বুঝতে পেরে অন্য উপায়ে কিভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে তাদের বিজেএমসিতে বহাল রাখা যায় যোগসাজশকারী বিজেএমসির কতিপয় কর্মকর্তা সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তারই কৌশল হিসেবে পিও-২৭, ১৯৭২ এর ধারা ১৬ এর অপব্যবহার করে পিআরএল গমনের তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য প্রশাসন ক্যাডারের ওই তিন কর্মকর্তাকে বিজেএমসির পরিচালক পদের বিপরীতে উপদেষ্টা পদে (পরিচালক পদের নির্বাহী ক্ষমতাসহ) নিয়োগের বিষয়ে বিজেএমসির আইন উপদেষ্টার মতামত গ্রহণ সাপেক্ষে বিজেএমসির বোর্ড সভায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন লাভের উদ্দেশে প্রস্তাবটি প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কর্মকর্তাগণ বিজেএমসির নিজস্ব কর্মকর্তা নয় বিধায় তাদের নিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবের সকল নথিতে এ তথ্যটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে গোপন রাখা হয়। মতামতে বিজেএমসির আইন উপদেষ্টা প্রথমেই সুষ্পষ্টভাবে বলেছেন, উপদেষ্টাদের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান অত্র আইনে নেই। বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের কর্মচারী প্রবিধানমালা ১৯৯০ এর ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, অবসর গ্রহণ এবং উহার পর পুনঃনিয়োগের ব্যাপারে কোন কর্মচারী পাবলিক সার্ভেন্টস রিটায়ার্ডমেন্ট এ্যাক্ট ১৯৭৪ এর বিধানাবলী দ্বারা পরিচালিত হইবেন। ওই আইনের ৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত কোন গণকর্মচারী কোনভাবেই প্রজাতন্ত্রের অথবা কর্পোরেশনের জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চাকরিতে পুনরায় নিয়োজিত হইতে পারিবেন না। তবে অত্র আইনের ৩ উপধারা অনুসারে অবসর গ্রহণের পর কোন গণকর্মচারীকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারেন। গণকর্মচারী (অবসর) বিধিমালা ১৯৭৫ এর ৮(১) এ বলা হয়েছে, গণকর্মচারী অবসর আইন ১৯৭৪ এর ৫ ধারায় ৩ উপধারার অধীনে অবসর গ্রহণের পর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগের প্রতিটি প্রস্তাব সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রক্রিয়া এবং কার্যকর করতে হইবে। আবার ৮(২) এ বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি এই উদ্দেশে সরাসরি কোন আদেশ প্রদান না করলে সেই নিয়োগের শর্তাদি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করতে হইবে। তবে আরও সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য এই বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়া যেতে পারে। জানা যায়, বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত লাভের উদ্দেশে বিজেএমসির আইন উপদেষ্টার মতানুসারে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নিকট লিখিত পত্র প্রেরণ করে। যেহেতু প্রেষণ বাতিল হওয়ার পরও কর্মকর্তাত্রয় অবৈধভাবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখে সেহেতু বেআইনীভাবে আর্থিক সুবিধা দেয়ার জন্য পিআরএল গমনের তারিখ থেকে পুনঃনিয়োগ কার্যকর করার উদ্দেশ্যেই প্রস্তাবটি প্রেরণ করা হয়। কিন্তু প্রস্তাবটির সপক্ষে পরিকল্পনাকারীরা আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত লাভে ব্যর্থ হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও অনুমোদন প্রদান করেনি। তাই মরিয়া হয়ে পাবলিক সার্ভেন্টস রিটায়ার্ডমেন্ট এ্যাক্ট ১৯৭৪ এর বিধানাবলী তোয়াক্কা না করে পিও-২৭, ১৯৭২ এর ক্লজ ১৬ এর একটি অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে প্রস্তাবটি পুনঃরায় উত্থাপন করা হয়। মূলত একটি বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পিআরএল আদেশাধীন প্রশাসন ক্যাডারের ওই তিন কর্মকর্তাকে যেনতেন প্রকারে বিজেএমসির পরিচালক পদের বিপরীতে উপদেষ্টা পদে (পরিচালকের নির্বাহী ক্ষমতাসহ) নিয়োগের সকল চেষ্টা চালানো হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ একটি আন্ডারগ্রাউন্ড দৈনিকে উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যাতে ওই তিন কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ এসব পদে আবেদন করতে না পারে। তাছাড়া, বিজ্ঞপ্তিতে এমনভাবে শর্তাবলী আরোপ করা হয় যাতে এই তিন কর্মকর্তা ব্যতীত বাংলাদেশের অন্য কোন ব্যক্তির সুযোগ না থাকে। কথিত সাজানো বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ২৩ ফেব্রুয়ারি ওই তিন কর্মকর্তার আবেদনপত্র গ্রহণ করে একই দিনে সাক্ষাতকার গ্রহণ, নিয়োগপত্র প্রদান, তাদের যোগদান ও দায়িত্ব বণ্টনসহ সবকিছু দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সকল বিধিমালা ভঙ্গ করে নিয়োগপত্রে নিয়োগের মেয়াদকাল উল্লেখ করা হয়নি। কেউ আইনের আশ্রয় নিয়ে ওই বিধিবহির্ভূত নিয়োগ প্রদানে যাতে কোন প্রকারেই কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সে লক্ষ্যেই একই দিনে সবকিছু সম্পন্ন করা হয়। অথচ তিন কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পিআরএল ভোগরত থাকা সত্ত্বেও তাদের উপদেষ্টা পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপত্রের অনুলিপি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়নি। সরকারী চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে তারা পিআরএল ভোগরত অবস্থায় সরকারের আরেকটি বিভাগে চাকরির জন্য আবেদন, যোগদান ও বেতন গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে এই তিনজন পিআরএলভুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে একই সময়ে সরকারের দুটি বিভাগ থেকে পৃথকভাবে আর্থিক সুবিধাও ভোগ করছেন, যা সরকারী বিধিবিধানের চরম লঙ্ঘন এবং সরকারী তহবিল তছরুপের শামিল। এ ব্যাপারে একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর কাছে। যার অনুলিপি দুর্নীতি দমন কমিশনেও দেয়া হয়েছে। অভিযোগে পিআরএল ভোগরত প্রশাসন ক্যাডারের ওই তিন কর্মকর্তার বিজেএমসির উপদেষ্টা পদে অবৈধ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং আইনবিরোধী নিয়োগের সঙ্গে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনের আওতায় যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে।
×