ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

সুদান থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

সুদান থেকে ফিরে

সুদানের আকাশে মেঘ নেই। দিনের বেলায় আকাশে সূর্য্যরে পাশাপাশি চাঁদও দেখা যায়। এমন দৃশ্য হয়তো অনেক দেখা যায়। কিন্তু আফ্রিকার এই দেশটির আকাশ গাঢ় নীল। বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। বছরের দু’এক মাস দেশটিতে বর্ষাকাল। বর্ষাকালে হঠাৎ বৃষ্টি হয়। তাও আবার সব এলাকায় না। বৃষ্টির পরিমাণটা দক্ষিণ সুদানে বেশি। দক্ষিণ সুদানেই মূলত খাদ্য শস্য ফলে। আর এখান থেকেই সুদানে খাদ্য শস্য সরবরাহ হয়। দক্ষিণ সুদান জন্মের আগে আফ্রিকা মহাদেশের এই দেশটি দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন উত্তর সুদান বা সুদান আফ্রিকা মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। দুই সুদান মিলে মাত্র আড়াই কোটি মানুষের বসবাস। গোটা দেশ জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে সুদানের দারফুর প্রদেশ সবচেয়ে সম্পদে ভরা। আর যত রক্তপাত এই সম্পদকে কেন্দ্র করেই ঘটছে। রক্তপাতের ভেতরে চলছে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি। কার ভাগে কোন সম্পদ যাবে তা ঠিক করেই জাতিসংঘ বাহিনীর খরচ বহন করা হচ্ছে। সম্প্রতি দেশটি সফর করে এসেছি। গত নবেম্বরের ২৩ থেকে ডিসেম্বরের এক তারিখ পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছি। বেশির ভাগ এলাকায় যেতে হয়েছে জাতিসংঘের উড়োজাহাজে। বাংলাদেশ থেকে দেশটির শান্তিমিশন পরিদর্শনকারী ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের দলনেতা ছিলেন ৫৫ পদাতিক ডিবিশনের জিওসি (যশোর) মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী। আমরা দেশটি পরিদর্শন করতে গিয়ে জানলাম-জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনায় সুদানের দারফুর এলাকায় সংঘাত দিন দিন প্রকট হচ্ছে। ছোট বড় সব গোত্রের মধ্যেই এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সব গোত্রের হাতেই অস্ত্র। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। এই সংঘাতের ফল ভোগ করতে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কাজ চলছে দেশটিতে। পশ্চিমাদের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতিটি গোত্র হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। যদিও এমন পরিস্থিতি শান্ত করতে জাতিসংঘ দেশটিতে শান্তিরক্ষী নিয়োগ করেছে। কিন্ত এতেও সুদানের দারফুরে শান্তি ফেরেনি। বিদ্রোহীরা আরও বড় অস্ত্র উচিয়ে এক গোত্র অন্য গোত্রের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রতিনিয়ত লাশ পড়ছে। লাখ লাখ মানুষ পাশের দেশ চাঁদ ও কঙ্গোতে পালিয়ে জীবন রক্ষা করছেন। শরণার্থী হিসেবে সুদান বিশ্বের তৃতীয় নম্বর দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। জাতিগত দাঙ্গা আর ধর্মীয় উত্তেজনায় শুধু সুদানের দারফুর প্রদেশেই নিহত হয়েছেন সাড়ে লাখ মানুষ। নিষ্ঠুর এই হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও ঘটেনি। জাতিসংঘ দারফুরে শান্তি রক্ষায় শান্তিরক্ষী মোতায়েন করেছে ২০০৭ সালে। শান্তিরক্ষীরা সেই থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তবু হত্যাযজ্ঞ থামছে না। তবে দেশটির বিদ্রোহী এলাকায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অভূতপূর্ব সাফল্য রেখে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহী নানা গোষ্ঠীর অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করেছে। উদ্ধার করেছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র গোলা বারুদ। তারা দেশটিতে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। তারা সেখানকার বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর বেশ কয়েক জনকে অস্ত্রসহ আটক করতে পেরেছে। অন্য যে কোন দেশের শান্তিরক্ষীর চেয়ে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীর ভূমিকা ভাল বলে জাতিসংঘ উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশ থেকে দেশটির শান্তি মিশন পরিদর্শনকারী ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতা মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সুনাম দেশে দেশে রয়েছে। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। প্রতিটি ক্যাম্পেই দারফুরে সাফল্যের নানা উদাহরণ রেখেছে। জাতিসংঘও বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের বিভিন্ন সময় প্রশংসা করেছে। গোটা দারফুরের ‘রেড জোন’ জেবেলমারায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীদের অভিযান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকাটিতে কোন দেশের শান্তিরক্ষীরা প্রবেশ করতে পারেনি। এখন জাতিসংঘ থেকে রেড জোনে শান্তিরক্ষী ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেবেলমারায় নতুন ক্যাম্প স্থাপন হলে দায়িত্ব দেয়া হবে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের। এটা একটা বড় স্বীকৃতি। জাতিসংঘের আস্থায় কাজ করে যাওয়া বাংলাদেশের কমান্ডো শান্তিরক্ষীরা মরুভূমি আর পাহাড়ে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিত বিদ্রোহী এলাকাগুলোতে টহল দিচ্ছে। অন্য দেশের শান্তিরক্ষীরা যে কাজ করতে সাহস পায় না তা বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সফলতার সঙ্গে করছে। এতে যেমন শান্তিরক্ষীদের সুনাম বাড়ছে তেমনি বাড়ছে দেশের সুনামও। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার একটি কাজ শান্তিরক্ষীরাও করে যাচ্ছেন। জেনারেল নাঈম বলেন, আমরা দেশটিতে বাংলাদেশের তিনটি শান্তিরক্ষা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছি। প্রতিটি ক্যাম্পের সদস্যদের মধ্যে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি পেয়েছি। তারা দেশেও যে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেন-শান্তি মিশনেও একই আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করছেন। আমি শান্তিরক্ষীদের নিয়ে দুটি দরবার করেছি। প্রতিটি দরবারেই শান্তিরক্ষীদের দৃঢ় মনোবল দেখেছি। তাদের সাহস আমাকে সত্যিই গৌরবান্বিত করেছে। দরবারে তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা জানতে চেয়েছি। তারা আমাকে জানিয়েছে, দেশের গৌরবকে আরও উজ্জ্বল করতে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রায় চার যুগ আগে বাংলাদেশ নামের একটি দেশ বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। সেই দেশটি এখন বিশ্বের বুকে নানা দিক থেকে সুনাম বয়ে নিয়ে আসছে। শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের যে কোন দেশের শান্তিরক্ষীর চেয়ে বেশি কাজ করে তার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। গত কয়েক দিন শান্তিরক্ষীদের বিভিন্ন কাজকর্মের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমাকে কিছু অসুবিধার কথা জানিয়েছে। আমি অসুবিধার বিষয়গুলো সেনাপ্রধানকে অবহিত করব। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় জানানো হয়েছে। জাতিসংঘ মিশনে স্থায়ী চাকরি করেন বাংলাদেশের জহুরুল ইসলাম (বেসামরিক)। তার সঙ্গে কথা হয়েছে এলফেসারে অবস্থিত জাতিসংঘ মিশনের সদর দফতরে। ১০ বছর ধরে তিনি সুদানের দারফুরে আছেন। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম দারফুরের সমস্যার মূল কারণ কি। তিনি সোজা জবাব দিলেন, এটা আর কিছু না। এখানে মাটির নিচে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। এই সম্পদই এদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পদে ভাগ বসাতে অন্য হাত প্রতিনিয়ত নানা কাজ করছে। একটি মাত্র তেল খনি তা দিয়েই দক্ষিণ ও উত্তর সুদানের অর্থনীতি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। আমাদের চার টাকার সমান এদেশের এক টাকা (পাউন্ড)। তাহলে ধরে নিতে হবে অর্থনীতি শক্ত অবস্থানেই আছে। কিন্তু তা থাকলে কি হবে এখানে বেশিরভাগ মানুষের ‘ইন্টারনাল মাইগ্রেশন’ ও দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। দেশের মধ্যে জাতিসংঘ পরিচালিত কয়েক শ’ আইডিপি (ইন্টারনাল ডিজলোকেশন পিপুল) রয়েছে। জাতিসংঘই এদের খাবার চিকিৎসা ও বস্ত্র দেয়। আইডিপিগুলোতে কি পরিমাণ মানুষ থাকেন এমন প্রশ্নে জহুরুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি আইডিপিতে কয়েক লাখ লোক বসবাস করেন। যারা বাইরে রয়েছেন, তারা মূলত বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তাদের হাতে রয়েছে অস্ত্র। এই সংঘাত নিরসন এবং তার পরিণতিতে যাতে নৃশংসতা না ঘটে তা প্রতিরোধের উপায় খোঁজার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল নানা উদ্যোগ নিয়েও তেমন কোন সমাধানে আসতে পারেনি। ইহুদী নিধন, ক্যাম্বোডিয়া, রোয়ান্ডাসহ বিশ্বে যত গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে তার চেয়ে বেশি গণহত্যা ঘটেছে দারফুরে। বীভৎস এবং একটি নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞের পিছনে বড় বড় শক্তির ইন্ধন ছিল বলে তিনি মনে করেন। জাতিসংঘ মিশনে কাজ করতেন বাংলাদেশ পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি রাজিয়া সুলতানা। এখন তিনি পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে জাতিসংঘ মিশনের স্থায়ী স্টাফ হিসেবে কাজ করছেন। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, জাতিগত সহিংসতা বন্ধ হওয়ার খুব একটা লক্ষণ নেই। কারণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সবার হাতেই অস্ত্র রয়েছে। এলাকাটা এত দুর্গম মরু ও পাহাড়ি যে বিদ্রোহীরা সহজেই নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে জাতিগত এবং ধর্মীয় উত্তেজনা বিপজ্জনকভাবে বাড়তে দেখছি। বিশ্বের অনেক দেশেই চরম সহিংসতা ঘটেছে। কিন্তু এখানে যা ঘটছে তা কল্পনা করা যায় না। সহিংসতার ঘটনা গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ইরাক, কিরঘিজস্তান, মালি, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিরিয়াকেও হার মানিয়েছে। রক্তপাত বন্ধ ঠিক কবে হবে তা বলা খুব মুশকিল। দেশটির সম্পদই হচ্ছে বড় কাল। এই সম্পদগুলো যতদিন থাকবে ততদিনই অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। তারা বলছেন, এ যুদ্ধ শেষ হবার না। এখানে যে যুদ্ধ হচ্ছে তা হচ্ছে সম্পদ কেন্দ্রিক। কোন আদর্শিক যুদ্ধ এখানে চলছে না। চলবে... লেখক : সাংবাদিক
×