ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়ের আনন্দ, পৌষের রোদমাখা দিন মিলে মিশে একাকার

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

বিজয়ের আনন্দ, পৌষের রোদমাখা দিন মিলে মিশে একাকার

জনকণ্ঠ ফিচার পউষ এলো গো! পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে। ঐ যে এলো গো...। বছর ঘুরে আবারও এসেছে পৌষ। শুক্রবার ছিল ১ পৌষ ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। আজ দ্বিতীয় দিন। পৌষ মানেই শীতের শুরু। একদিকে চলছে পিঠাপুলির উৎসব। পৌষ মেলা। শীত উপভোগ করছে বাঙালী। অন্যদিকে মেতেছেন বিজয়ের আনন্দে। আজ ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ অর্জনের দিনে লাল সবুজে দারুণ সেজেছে দেশ। মহান বিজয় দিবস আর পৌষের রোদমাখা দিন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কবিগুরু বলেছিলেন, পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয়...। এখন ছুটে আসার দিন। উৎসবে যোগ দেয়ার সময়। প্রিয় ঋতু শীতের জন্য অপেক্ষা করে থাকে বাঙালী। এ সময় নগরে-গ্রামে আয়োজন করা হয় নানা উৎসব অনুষ্ঠানের। কবির ভাষায় শীত এসেছে লাগলো কাঁপন, লাগলো দোলা প্রাণে শীত এসেছে হিমেল হাওয়া, আনন্দ আর গানে...। অবশ্য পৌষ শুরুর আগে অল্পস্বল্প শীত অনুভূত হচ্ছিল। এখন তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকবে। আবহাওয়া অফিস বলছে, বাংলাদেশ বিষুবরেখার উত্তরে। প্রায় সাড়ে ২৩ ডিগ্রী অক্ষাংশে। কিন্তু শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুবরেখার দক্ষিণে চলে যায়। দক্ষিণে কিছুটা হেলে থাকে। দিন ছোট হয়। বড় হতে থাকে রাত। ফলে শীতের প্রকোপ বাড়ে। বাংলাদেশে যখন শীতকাল, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশে তখন গ্রীষ্ম। ওসব দেশে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উত্তর গোলার্ধ থেকে ঠান্ডা বাতাস দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে বরফশীতল বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। আসে সাইবেরীয় ঠান্ডা ও। আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে যে ঠা-া বাতাসের প্রবল প্রবাহ সৃষ্টি হয়, তা শৈত্যপ্রাহ নামে পরিচিত। এ সময় তীব্র ঠান্ডা অনুভূত হয়। তবে মাঘের শীত সবচেয়ে বেশি আলোচিত। বলা হয়ে থাকে, মাঘের শীতে বাঘা পালায়! পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের শীতের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতের পার্থক্য বিস্তর। কোন কোন দেশে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীতে নেমে আসে। খুব কাছের দেশ চীনেও তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নয়-দশ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়! মেরু অঞ্চল বা এন্টার্কটিকার কথা তো বলাই বাহুল্য। অথচ বাংলাদেশে তাপমাত্রা ছয় থেকে পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে খুব একটা নামে না। সেদিক থেকে বাংলাদেশের শীত অনেকখানি উপভোগ্য। শীত সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে গ্রামীণ জীবনকে। পৌষে কৃষকের ফসল ঘরে তোলার কাজ শেষ হয়ে যায়। হাতে তেমন কাজ থাকে না। সবাই উৎসব-আনন্দে মাতে। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে ঘরে ঘরে চলে পিঠাপুলির আয়োজন। পৌষের প্রকৃতিও অদ্ভুত সুন্দর। প্রতিবারের মতো এবারও নতুন রূপে সেজেছে। বদলে গেছে অনেক ধরাবাঁধা নিয়ম। এখন সকাল হলেই সূর্যালোকের দেখা মেলে না। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। রাতে শিশির ঝরছে। প্রকৃতির এ রূপ বর্ণনা করেই জীবনানন্দ লিখেছিলেন শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়, কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...। অন্য কবির কবিতায় বর্ণনাটি এ রকম বিষাদের প্রতিমূর্তি হে শীত, সবুজের পোষাক খসিয়েছ/নিয়েছ জড়িয়ে কুয়াশার শুভ্র চাদরে তপসীর সাধনায়...। পৌষে এই কুয়াশা এত হয় যে প্রতিদিনের সূর্যওঠা ভোরও দেখা যায় না। সূর্যের আলোর জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়। সুকান্ত তাই লিখেছিলেন, সকালের এক-টুকরো রোদ্দুর এক-টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী।/ঘর ছেড়ে আমরা এদিক-ওদিকে যাই এক-টুকরো রোদ্দুরে তৃষ্ণায়...। গ্রামের সাধারণ কৃষক অবশ্য সূর্যের অপেক্ষা করে না। রাত পোহাবার আগেই ঘুম থেকে উঠে আইলায় হাত সেঁকে নেয়। এভাবে যেটুকু সম্ভব উষ্ণতা সঞ্চয় করে চলে যায় ফসলের মাঠে। শীতে ফসলের মাঠও যেন নতুন প্রাণ পায়। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার ভাষায় এ সময় সরিষার ক্ষেতে চোখ আটকে যায়। চোখ ধাঁধানো রূপ, রঙের খেলা মনে করিয়ে দেয় শীত এসেছে। খেজুরের রসে ভরে ওঠে মাটির কলসি। ম ম গন্ধ ছড়ায়। শীতের হাওয়ায় কাঁপন ধরে আমলকীর বনে। কবিগুরুর ভাষায় শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে...। এদিকে, পৌষ যখন শুরু হলো ঠিক তখন বিজয়ের আনন্দে ভাসছে বাঙালী। আজ ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রু মুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা শেষ শত্রুটিকে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন। এই আনন্দের কোন তুলনা হয় না। পৌষের পিঠাপুলির দিন আর বিজয়ের আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে আজ।
×