ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইমিটেশন গয়নার গ্রাম

সীতাহার, সাতনরিহার তৈরি হচ্ছে বগুড়ায় বিপণন সারাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

সীতাহার, সাতনরিহার তৈরি হচ্ছে বগুড়ায় বিপণন সারাদেশে

সমুদ্র হক সীতাহার, সাতনরিহারও মিলছে সেই গ্রামে। নেকলেস (মালা বা মনিহার), ব্রেসলেট, চুড়ি, রিং, দুল, ঝুমকা, টিকলি, চুর, নূপুর, নোলক, বাজু, বিছা; কি নেই। ঘরে ঘরে কুটিরশিল্পে পরিণত হওয়া এই গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে গয়নার (গহনা) গ্রামে। এসব গহনা দেখে প্রথমে সোনার গহনা মনে করে হোঁচট খেতে হয়। দাম শুনে সেই ভ্রম কিছুটা ভেঙ্গে যায়। তখন বিস্ময়ে বলতে হয়, এত নিখুঁত ইমিটেশন গ্রামের মানুষ কী করে বানাচ্ছেন! যারা বানাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই নারী। সে রকম কোন যন্ত্রপাতি নেই। মণিকাররা (স্বর্ণকার) হাতের কাজে (ম্যানুয়ালি) যে ছোট হাতুিড় ও আনুষঙ্গিক জিনিস ব্যবহার করে এদের কাছেও তাই থাকে। কাটিং করার জন্য ছোট একটি যন্ত্র কিনে নিয়ে তার মধ্যে মাল্টিপল ফাংশন জুড়ে দেয়া হয়েছে। ছোট ও মাঝারি গহনা রং ও পলিশ সেই যন্ত্রেই হয়। গহনার মধ্যে সকল ধরনের পাথর বসিয়ে দেয়া হয়। ক্রেতারা সীতাহার, সাতনরিহারের মতো বড় গহনাগুলো তাদের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আরও ভাল ফিনিশিং দেয়। তামা ও পিতলের তৈরি এসব গহনা বগুড়া থেকেই বিপণন হচ্ছে বগুড়া-ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের জেলাগুলোয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, কোন কোন ইমিটেশনের দোকানি এসব গহনা ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বলে বিক্রি করেন। বোঝার কোন উপায় নেই। বগুড়া নগরী থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ৫ কিলোমিটার দূরে বারোপুর, দক্ষিণপাড়া, ধরমপুর গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই তৈরি হচ্ছে এসব গহনা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির আঙিনায় বসে নারীরা তৈরি করে এই গহনা। এর কাঁচামাল তামা ও পিতল; যা পাইকারি দরে কিনে আনা হয় দক্ষিণাঞ্চলের যশোর থেকে। এই তামা ও পিতল গলিয়ে গহনার নক্সার ডাইসে ভরে দেয়া হয়। ডাইস আগে আসত যশোর থেকে। বর্তমানে বগুড়ার অনেক কারিগর নিজেদের মেধায় ডাইসের নক্সা বানিয়েছে। তামার নক্সি ডাইস প্রতিটি বিক্রি হয় মানভেদে ১৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকায়। পিতলের ডাইস ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ টাকায়। গহনা তৈরির ছোট প্রতিষ্ঠানের (যা বাড়ির মধ্যে) নামও আছে। বাড়ির মালিক অথবা তার স্ত্রী-সন্তানের নামের সঙ্গে ‘গোল্ড হাউস ও কারখানা’ জুড়ে দিয়ে একটি পরিচিতি দেয়া হয়েছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্রেতা এই গ্রামে গিয়ে পাইকারি দরে গহনা কেনে। কেউ ক্যাটালগ দেখিয়ে পছন্দের গহনা বানিয়ে নেয়। কারিগর রেশমা পারভীন জানালেন, বর্তমানের অনেক তরুণী ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল ও মুম্বাই ফিল্মের তারকাদের পরিহিত গহনা গুগল থেকে নামিয়ে স্মার্ট ফোনে তুলে এনে দেখায়। কারিগররা শেয়ারআইটি (শেয়ারইট) প্রোগ্রামে তা তুলে নেয়। পরে অবিকল ওই গহনা বানিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে কোমরের বিছা, নোলক, নূপুর বিক্রি বেড়ে গেছে। বারোপুর দক্ষিপাড়া গ্রামের রোজিনা, সাবিনা, সাহিদা, রিপা ও মুন্নী জানালেন নিকট অতীতে এই গ্রামের মানুষের সচ্ছল অবস্থা ছিল না। কেউ কৃষিকাজ করেছে। অনেককেই কর্মহীন হয়ে থাকতে হয়েছে। নারীরা গৃহবধূ হয়ে থেকেছে। বছর কয়েক হয় এই গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি পাড়া ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিটি ঘরের নারী এখন গহনা বানিয়ে জীবিকার বড় পথ খুঁজে পেয়েছে। পুরুষদের অনেকে কাঁচামাল (তামা ও পিতল) কিনে আনে বাইরে থেকে। পাশের গ্রাম ধরমপুরে কাঁচামাল বিক্রির পাইকারি দোকান বসেছে। এই গ্রামের বেশিরভাগ কারিগর গহনার কাজ শিখেছেন অল্প দূরের আটাপাড়া গ্রামে। বগুড়ার এই গ্রামটি স্বর্ণকারের গ্রাম নামে অধিক পরিচিত। মূলত এই গ্রামের লোকজনই তামা-পিতলের গহনা তৈরি করে প্রথমে। দিনে দিনে তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামে। কারিগর কালাম জানালেন, দেশের গ-ি ছাড়িয়ে এই গহনা এখন বিদেশবিভুঁইয়েও পৌঁছে গেছে। কিভাবে! এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যারা বিদেশে যান তারাও এই গহনা সঙ্গে করে নিয়ে যান।
×