শিশুরা সমাজে সবচেয়ে প্রিয়মুখ। শিশুদের পেছনে প্রচুর সময় দিতে হয়। আবার শিশুরাও সময় দেয় আমাদের। তাদের সাথে যেসময়টুকু থাকা হয়, সেই সময়টাও আমাদের কাছে মূল্যবান, প্রাইমটাইম। যারা নিয়মিত শিশুদের সাথে সময় কাটান, তারা অনেক রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকেন। তাদের সাথে আমরা শিশুর মতোই আচরণ করি। তাদের সাথে যতক্ষণ থাকি সেসময়টুকু ছাড়াও আমরা আরো কিছু সময় ভালো থাকি। সেটা হলো সেইসময়টুকুর আবেশ। ভালো থাকার জন্য শিশুর সংস্পর্শ জরুরি। শিশুর হাসি বিশ^জয়ী। শিশু অসাম্প্রদায়িক। শিশু ভয়মুক্ত। শিশু সর্বকলুষমুক্ত। যে ঘরে শিশু নেই সেই ঘরের আনন্দে কিছুটা ঘাটতি থাকে। শিশুকে কেন্দ্র করে আমরা আলাদা জগত তৈরি করি। তাদেরকে বিষমুক্ত রাখার জন্য আমরাও বিষমুক্ত হই। গাছ যেমন আমাদের অনেক রসদ যোগায়, তেমনি শিশুরাও আমাদের অনেক কিছু দেয়। গাছের দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধতা হয়তো আছে, শিশুর দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধতা নেই। অনেকে অভাবের সংসারে বাচ্চার কথা ভাবতেই চায় না। আসলে আমার ধারণাটাও পরিবর্তন হলো যখন আমাদের ঘর আলো করে ‘ঋদ্ধ’ এলো।
আমি যখন ঋদ্ধর সাথে সময় কাটাই, তখন আমার আপনজনের বাচ্চাদের কথা মনে পড়ে। আমার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ জাগে। কেন আমি আমার সন্তানের মতো করে ভাইয়ের সন্তান, বোনের সন্তাকে আদর-যতœ করতে পারি না! দেশের অন্যান্য শিশুর অবহেলা দেখলে আমি খুব কষ্ট পাই। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শিশুদের দেখে মনে হয় বাংলাদেশ যে কাজটি করছে, তার চেয়ে ভালো কাজ হয় না। জন্মের কয়েকদিন পরই ঋদ্ধ ভয়াবহ জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। আমি চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম আইসিইউতে থাকা বাবাকে দেখতে। ফিরে এসে দেখি ঋদ্ধকে ‘ফটোথেরাপি’ দেয়া হচ্ছে। কয়েকদিন পর শুনলাম মেডিকেলে এমন কয়েকটি নবজাতক আছে, যাদের মা দেশের বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে। সিজার হওয়ার কারণে বাচ্চাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এদের ব্রেস্টফিডিং করান অন্য নবজাতকের সুস্থ মায়েরা। আমি শুনলাম এ রকম এক বাচ্চাকে আমার শাশুড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি ছিল, যেখানে নিজের নাতি পরিমাণ মতো দুধ পাচ্ছে না, সেখানে অন্য বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সুযোগ কই! আমি আমার স্ত্রীকে বললাম- তুমি তোমার সন্তানের কাছে আছো, ওই সন্তানের মা বিপদগ্রস্ত, কাছে নেই। তাকে দুধ দাও। দুধের অভাবে ওই সন্তান মারা গেলে আমি আমার সন্তানের জীবনও চাই না। ও না বাঁচলে আমার সন্তানও বাঁচবে না।’ এরপর আমার স্ত্রী পরম মমতায় তাকে বুকের দুধ দিয়েছে।
এখনকার শিশুরা একটু বেশি দুষ্টুমি করে। এ অভিযোগ প্রায় সকলের। মাঝে মাঝে আমিও তা স্বীকার করি। কিন্তু তারপরও আমার নিজস্ব একটি বক্তব্য আছে। সেটি হলো আমাদের দেশের অনেক মা সন্তান পালনে অভিজ্ঞ, পারদর্শী কিংবা কৌশলী নয়। তাদের ধৈর্য্যশক্তিও কিছুটা সীমিত। তাঁরা সন্তান ধারণ ও জন্মদানের মতো কঠিন জটিল কাজটি করতে পেরেছে কিন্তু সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর লালন-পালনে কিছুটা অসহিষ্ণু। এ অভিযোগ আমারও।
মূলত শিশুরা কান্না করে তিনটি কারণে। এক. ক্ষিধা পেলে, দুই. আঘাত পেলে, তিন. অসুস্থ হলে। অনেক সময় কোলে ওঠার জন্য, একটু বাতাসে-আলোতে নিয়ে যাবার জন্যও ওরা বায়না ধরে। এসব ছোট ছোট চাহিদা যখন তার পূর্ণ হয় না, তখন সেই কাঁদবে বৈকি! জন্মের পরপর অনেক শিশুর কান্না থামে না। এটা অনেক সময় ক্ষুধার কান্নাই হয়। এটা মায়েরা বুঝতেই পারে না। সে মা যদি প্রথম সন্তানের জননী হন, তাহলে তো বোঝার কথাই না! তার উপর আছে মুরব্বিদের খবরদারি। জন্মের প্রথম ছয়মাস মায়ের দুধের বিকল্প কোন দানাপানি দেয়া নিষেধ। নতুন মায়েরা প্রায়শ জানায় দুধ আসছে না। ডাক্তারকে বলে অনেকে টিনের দুধ খাওয়ানোর অনুমতিও নিয়ে নেন। ভালো ডাক্তাররা কখনোই এটা সমর্থন করেন না। কোনো কোনো মা অথবা নানি-দাদি আছেন, যারা এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তারকে না জানিয়ে বিকল্প খাবার দেন শিশুকে। যা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়।
নতুন মাকে কেউ ভালো করে বুঝিয়ে বললে হয় যে, বাচ্চা দুনিয়াতে এলো, তার খানা সুরক্ষিত আছে মায়ের কাছে, সেটি বুকের দুধ। প্রথম দিকে একটু দুধ না আসলেও চেষ্টা করলে পরে দুধ আসে। দুএকদিন পর শিশুরা পরিমাণ মতো দুধ পায়। এটা হচ্ছে সম্পূর্ণ মায়ের ইচ্ছার উপর। এর জন্য চেষ্টা করতে হয়, একদিন, দুদিন নাহয় তিনদিন। চেষ্টা করে কোনো মা বিফল হয়েছেন এমন সংবাদ পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় বাচ্চার মাকে সাহস দেয়ার লোকও দরকার হয়। জানা লোক, অভিজ্ঞ লোক, সাহসী লোক। অথচ আমাদের সমাজে নতুন মায়েদের এসময় যারা পরামর্শ দেন, তাদের অধিকাংশই বৈদ্য, চিকিৎসক নন। এতে হিতে বিপরীত হয়। শিশুর ভবিষ্যত ঝুঁকির মুখে পড়ে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রথম দিকের কষ্টগুলোকে যদি আনন্দচিত্তে গ্রহণ করতে পারি, তাহলে সেই শিশুর ভবিষ্যত অনেকটা নিরাপদ। হয়তো সেই একদিন শিশুদের নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করবে।
ঢাকা থেকে