ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব প্রবীণ দিবস ॥ সবার দায়িত্বশীলতা কাম্য

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১ অক্টোবর ২০১৭

বিশ্ব প্রবীণ দিবস ॥ সবার দায়িত্বশীলতা কাম্য

বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে শিল্পী নচিকেতার গাওয়া জীবনভিত্তিক একটি গান রয়েছে। কাহিনীনির্ভর এ গানটি এমনভাবে গাওয়া হয় যে, শুনলে যে কারও চোখের পানি আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা জানি আজকে যে শিশু, কালকে সে যুবক, তারপরে তিনি বৃদ্ধ- এভাবেই চলে একটি মানুষের জীবনচক্র। তারপরে পরিণত বৃদ্ধ বয়সেই মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় আট শতাংশ প্রবীণ। সেই হিসেবে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ লোক প্রবীণ। কিন্তু জাতিসংঘের হিসেবে এ সংখ্যা সাড়ে ছয় শতাংশ, যা প্রায় এক কোটির কাছাকাছি। এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে প্রতিবছরের পহেলা অক্টোবরকে বিশ্ব প্রবীণ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তারপর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯১ সালের পহেলা অক্টোবর থেকে প্রতিবছর দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে। সেই অনুয়ায়ী জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৯৯ সালকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। রীতি অনুযায়ী দিবসটি পালনের জন্য একটি যুগোপযোগী প্রতিপ্রাদ্য বিষয় ঠিক করা হয়। ২০১৬ সালের জন্য একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছিল, ‘প্রবীণদের জন্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’। কারা প্রবীণ! ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু ছিল ৬০ বছর, ২০১২ সালে ছিল ৭০ বছর যা ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭১ বছরে। কাজেই বয়সের হিসেবে ষাট বছরের উর্ধ বয়সের কোন নাগরিককে প্রবীণ নাগরিক বলা হয়ে থাকে। এখন সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স হলো ৫৯ বছর যা পিআরএলসহ ৬০ বছর। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অবসরের বয়স হলো ৬৫ বছর, বিশেষ বিশেষ সময়ে কখনও কখনও তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। কিন্তু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য কোন অবসর সুবিধা নেই, নেই কোন অবসরের বয়সসীমাও। সময়ের হিসাবে মানুষ যতই প্রবীণ হয়, ততই তার জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে। কিন্তু তখন কমতে থাকে স্মরণশক্তি, কর্মক্ষমতা, আয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা, বাড়তে থাকে রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি। আর সে কারণেই সংসারে কমতে থাকে প্রবীণদের গুরুত্ব। আর এটি সবচেয়ে বেশি দেখা দেয় একান্নবর্তী পারিবারিক আবহে। দিনবদলের এ সময়ে এসে এখন একান্নবর্তী পারিবারিক বন্ধন বলতে কিছু আর বাকি নেই। কারণ সবাই নিজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চায়। যে প্রবীণ ব্যক্তিটি একসময় সংসারের সমস্ত হাল ধরে তার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানদের দায়-দায়িত্ব নিয়ে তার জীবনের সমস্ত কিছু ইনভেস্ট করে গড়ে তোলে তার পরিবার। প্রবীণ বয়সে তাকেই সবচেয়ে করুণ অবস্থায় পড়তে দেখা গেছে। তখন দেখা যায় তিনি তার পরিবারের ছোটদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে তাকে সহ্য করতে হয় নানা অবহেলা, গঞ্জনা-বঞ্চনা। তখন অনেকেই ভুলে যায় এ লোকটিই একসময় তার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে তাদের মানুষ করেছিল। এর মধ্যে কেউ কেউ যদিওবা কিছু দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, আবার দায়সারা গোছের। তারা কখনোই একটি বিষয় চিন্তা করে না যে তাদেরও এক সময় একই পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ছোটবেলায় আমাদের মা-চাচিদের কাছ থেকে বিভিন্ন গল্প শুনেছি। তার একটি হলো এরকম, ‘এক বৃদ্ধ মায়ের সন্তানের ছেলের বউ তার শাশুড়ি মাকে খুবই নির্যাতন করত। তারই অংশ হিসেবে রাগ করে একদিন শাশুড়িকে বাড়ি থেকে বাইরে ফেলে দেয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। তখন বাড়ির অদূরে একটি জঙ্গলের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর সেই শাশুড়ি বলে উঠেছিল, ‘বউমা এখানেই রাখ, আমি আমার শাশুড়িকেও এইটুকুই এনেছিলাম’। অর্থাৎ আমি যদি আমার মুরব্বিদের প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করি, তাহলে নিশ্চয়ই আমার অনুজেরাও হয়তো আমাকে তার প্রতিদান দেবে। কাজেই পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে প্রবীণদের জন্য প্রত্যেকের জায়গা থেকে কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকার দেশের প্রায় ২৭ লাখ প্রবীণ ও বয়স্ক নাগরিকদের জন্য মাসে চারশত টাকা হারে বয়স্কভাতা চালু করেছে। তাদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা শুরু হয়েছে। কিন্তু এটা যতটা ব্যাপকভাবে করা দরকার, সেই প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল বলা যায়। এ সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। অপরদিকে সরকার পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ২০১৩ সালে প্রবীণ হিতৈষী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এর মাধ্যমে কোন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে একলাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে, যা অনাদায়ে তিন মাসের জেল হওয়ার বিষয়েও বিধান রয়েছে এ আইনে। তারপরও ছিন্নমূল কিংবা পরিবারের সান্নিধ্যের বাইরে গিয়ে সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করা দরকার। পরিশেষে বলা যায় এটি একটি সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগের কর্মযজ্ঞ। সকলের মধ্যে একটি বিষয় ছড়িয়ে দেয়া দরকার, আর তা হলো প্রবীণরা পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের অভিশাপ বা বোঝা নয়, বরং তাঁরা আশীর্বাদ। কারও একার পক্ষে এর সমাধান এত সহজ নয়। এটি একটি পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা, কাজেই একে সম্মিলিত ও সমম্বিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। আর তাহলেই প্রবীণদের দোয়ার বরকতে সবাই মানসিক শান্তি নিয়ে ভাল থাকবে নিশ্চিন্তভাবে। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×