ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা নারীর দুর্বিষহ জীবন নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা নারীর দুর্বিষহ জীবন নাজনীন বেগম

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার, উখিয়া আর টেকনাফের দীর্ঘ এলাকাজুড়ে যে অপ্রত্যাশিত সঙ্কটের অবতারণা করা হয় সেখানে নারীদের অবস্থা যে কত শোচনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিপীড়িত, অত্যাচারিত নারী ও শিশুদের আর্ত চিৎকারের শরণার্থী শিবিরের যে বীভৎস অবস্থা তা শুধু মানবিক বিপর্যয়ের এক কলঙ্কিত দলিল। স্বামী ও সন্তানহারা অসহায় ও বিপর্যস্ত নারীদের জীবন শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। প্রকৃতিগতভাবে নারী-পুরুষের বিভাজনের মাত্রায় নারীরা দুর্বল আর অনেকাংশে নিরাপত্তাহীনতায় জর্জরিত। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো সেভাবে নিরাপদও নয়। এমনিতে কক্সাবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখের মতো জনগোষ্ঠীর বাস। সেখানে প্রায় ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশ পরিস্থিতিকে যেভাবে বেসামাল অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে যার পরিণতি খুব একটা সুখকর নয়। সাময়িক ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে এত বড় জনগোষ্ঠীর সমস্যা মেটানো আসলে অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। সড়কে, যেখানে সেখানে রোহিঙ্গা অভিবাসীদের অবস্থান উপস্থিত সঙ্কটকে নানা মাত্রিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে আবার নারী শরণার্থীদের অবস্থা মানবেতর এবং হরেক রকম সমস্যার আবর্তে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে বাসস্থান থেকে আরম্ভ করে স্নানাগার কিংবা শৌচাগারের যে পরিমাণ ঘাটতি সেখানে নারীরা পড়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে। মিয়ানমার থেকে স্থায়ী সমস্যা নিরসনে কোন প্রস্তাব এখনও সুদূরপরাহত। বাংলাদেশেও অবকাঠামোগত সংস্কার করে শরণার্থীদের উদ্ভূত পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে গৃহনির্মাণসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সঙ্কুলান করাও তেমনি আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে যেখানে আশু সমাধান বিরাট এক কঠিন সময়সাপেক্ষ ব্যাপক আর এই বিশৃঙ্খল ও অসহ্য পরিবেশের সিংহভাগ দায়ভাগ চাপে নারী ও শিশুদের ওপর। কারণ প্রতিদিনের কর্ম জীবন প্রবাহ তো সমস্যাকে কেন্দ্র করে থেমেও থাকেন। সময়ের মিছিলে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনীয় মুহূর্ত পার করা আসলে অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের অনিবার্য পরিণতি হরেক রকম ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া শরণার্থী শিবিরের নিত্য নৈমিক্তিক দুর্ঘটনা। আর এই সঙ্কটাবর্ত অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে নারী এবং শিশুরা। এমন মানবেতর বেহাল পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য পরিচর্যাও বিলাসিতার পর্যায়ে গিয়ে পড়ে। নারীদের নেমে আসতে হয় সর্বনাশের শেষ পর্যায়ে। নিরাপত্তার অভাব তো আছেই। আরও আছে প্রসূতি মায়ের সন্তানপ্রসবের অসহ্য যন্ত্রণা। সব থেকে বেশি করে আছে মেয়েদের প্রতি মাসের নিয়মিত রক্তস্রাবের অসহনীয় গ্লানি। জানি না কিভাবে মেয়েরা এই মাস মর্যায়ের বেসামাল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা। করছে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর পর্যাপ্ততা এবং এর সুষ্ঠু ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ব্যবহার করা আদৌ এই জঘন্য পরিবেশে সম্ভব হচ্ছে কিনা। সব ধরনের বিপদসঙ্কল অবস্থায় এই কারণে নারীদের অনেক বেশি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। প্রসূতি মা যেমন সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান একইভাবে তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর উপযুক্ত আর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে গড়ে তোলাও দায়বদ্ধতার মধ্যেই পড়ে। এই দায় শুধু মায়ের নয় পুরো সমাজের। অভিবাসী রোহিঙ্গা নারীরা সন্তান প্রসবের পর কি ধরনের অমানবিক জীবনযাপন করছে তার সদ্যজাত শিশুটিকে নিয়ে তা ভাবলেও অন্তরাত্ম শিউরে ওঠে শুধু রোহিঙ্গাদের প্রতিদিনের অস্বাভাবিক জীবনযাত্রাই নয় আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতও কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনায়ও আনা যাচ্ছে না। একটি স্বাস্থ্যকর, বিধিসম্মত পরিবেশে এসব উদ্বাস্তুকে যথার্থভাবে পুনর্বাসিত করা এক দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া সেটা রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমিতেই হোক কিংবা বাংলাদেশের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেই হোক না কেন। শুধু ত্রাণসামগ্রীর ওপর নির্ভর করে এত ব্যাপক অভিবাসী সঙ্কট মোকাবেলা করা বাংলাদেশের পক্ষে দুঃসাধ্য এবং কষ্টকর। দেশে বিদেশে, জাতিসংঘ কিংবা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা যেভাবে সাহায্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে সেখানে শুধু প্রতিদিনের খাদ্য সমস্যার সমাধান হলেও আরও অনেক প্রয়োজনীয় অবস্থাকে মোকাবিলা করতে যে পরিমাণ অর্থ আর সময়ের দরকার তারও যথার্থ ঘাটতি সামগ্রিক অবস্থাকে সুস্থির পর্যায়ে নিয়ে যেতে আরও অনেক অপেক্ষা করতে হবে। প্রতিদিনের সমস্যার সুরাহা না করেও কঠিন এবং অপরিকল্পিত কর্মপ্রবাহ নিরন্তর বয়ে চলেছে। আর এই বিব্রতকর অবস্থার শিকার হতে হচ্ছে নারীও শিশুদের। অপেক্ষাকৃত সবল এবং সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় কিছুটা অগ্রগামী পুরুষরা একটু তো সুবিধাজনক অবস্থানে। রোহিঙ্গা পুরুষ শরণার্থীরাও যে খুব বেশি ভাল আছে তা কিন্তু বলা যাবে না। মেয়েদের কিছু শারীরিক অসহায়ত্ব এবং দুর্বলতার কারণে তারা কিছুটা পিছিয়ে তো বটেই। তবে উপস্থিত প্রয়োজন মেটানোর চাইতেও স্থায়ী কোন সমাধান এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি জরুরী। যে দায়ভাগ একমাত্র মিয়ানমারেরই। পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা দিয়ে স্বদেশের ভূমিতে তাদের স্থায়ী অবসান নিশ্চিত আর নিরাপদ করা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী এবং শান্তির বার্তাবহ আউং সান সুচির নির্বাচিত সরকারের প্রথম এবং প্রধানতম দায়িত্ব। যে দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করলে শুধু মানবতাই লঙ্ঘিত হবে না, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্ত আইনকানুন বিধি ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে যা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে বেশি অন্তরায়।
×