ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশজুড়ে পূজার প্রস্তুতি

অশুভ শক্তির বিনাশে সম্প্রীতির বাঁধন শারদীয় দুর্গোৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

অশুভ শক্তির বিনাশে সম্প্রীতির বাঁধন শারদীয় দুর্গোৎসব

সমুদ্র হক শান্ত স্নিগ্ধ শরতের কাশবন দুলে উঠেছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। বসুন্ধরার প্রতীক নয়টি গাছের পাতাকে একসঙ্গে সজীব করে তোলা হয়েছে। পৌরাণিক বর্ণনায় ব্রহ্মার দাবি, পৃথিবীতে পদ্মই শ্রেষ্ঠ ফুল। অঞ্জলির ১শ’ ৮টি পদ্মও সংগ্রহ করা হচ্ছে। শারদীয় উৎসবে ঢাকিরা ঢাকের কাঠি নিয়ে প্রস্তুত। বড়দের কেনাকাটা আর শিশুদের মুখে সুর ‘আয়রে ছুটে আয় পূজার ঘণ্টা বেজেছে ...।’ এবারের শরতে অশুভ সকল শক্তির বিনাসে সম্প্রীতির বাঁধনে ত্রিভুবন এখন শারদীয় দুর্গোৎসবে মেতে উঠেছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী, সনাতন বিশ্বাস ও বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে পৃথিবীর মঙ্গল কামনায় দশভুজা শক্তিরূপী দেবী দুর্গার এবার কৈলাশ থেকে পিতৃগৃহ মর্ত্যালোকে আগমন নৌকায় চড়ে। স্বর্গালোকে ফিরবেন ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে। ইতোমধ্যে মহালয়া আয়োজন ও চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। তবে উৎসবের পালা শুরু হয়েছে এর আগেই। এই সময়টায় তার গতি পেয়েছে। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ষষ্ঠী বিহীত পূজার মাধ্যমে সায়ংকাল। শুরু আমন্ত্রণ অধিবাস। এভাবে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী হয়ে বিজয়া দশমীতে হবে বিসর্জন। পুরোহিতের ভক্তিকণ্ঠে মন্ত্র উচ্চারিত ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা ... নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমোঃ নমোঃ ...।’ এরপর ম-পগুলোতে ধূপের ধোঁয়া, ঢাক, ঢোলকের বাদ্যি, কাঁসরবাদ্য, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, পূজা অর্চনা প্রসাদ বিতরণসহ নানা অনুষঙ্গে ভরে ওঠে। লুচি, লাবরা (সবজি), নারকেলের নাড়ু, চিড়া মুড়ির মোয়া, খিঁচুরি দিয়ে আপ্যায়ন। ছেলেরা পরবে ধূতি, নক্সী-পাঞ্জাবি, মেয়েরা বাহারি শাড়ি, ছোট্ট ছেলেমেয়েরা নতুন পোশাক। মেয়েরা পরস্পরের সিঁথিতে, হাতের নোয়ায় সিঁদুর দিয়ে মঙ্গল ও সৌভাগ্য কামনা করবে। পূজার দিনগুলো কাটবে আনন্দে।দুর্গা শব্দের অর্থ যিনি জীবের দুর্গতি হরণ করেন। আরেক অর্থ দুর্জ্জেয়া। সকল দেবের সমম্বিত শক্তি দুর্গা দেবী উমা, পার্বতী, গৌরী নামেও পরিচিতি পান। দুর্গার কাহিনী বর্ণিত আছে মার্কেন্ডেয় পুরাণের চ-ীর সপ্তদশ অধ্যায়ে। চ-ীপাঠ দুর্গাপূজার অপরিহার্য বিষয়। পুরাকালে একসময় অসুরদের রাজা মহিষাসুর দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করে স্বর্গরাজ্যের অধিপতি হয়ে বসে। অসুরদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেলে দেবতারা ব্রহ্মাকে সামনে রেখে শিব ও বিষ্ণুর কাছে গিয়ে অসুরদের কার্যকলাপ বর্ণনা করেন। মহিষাসুর বিনাশের উপায় বের করার আবেদন জানান। এসব কথা শুনে শিব ও বিষ্ণু এতটাই ক্ষুব্ধ হলেন যে মুখম-ল থেকে মহাতেজ নির্গত হলো। এমন তেজ নির্গত হলো ব্রহ্মা, ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতার শরীর থেকেও। সকল তেজরাশি মিলে এক দেবমূর্তি ধারণ করল। তিনিই দেবী দুর্গা। দেবতারা এই মহাদেবীকে সাজিয়ে দিলেন অস্ত্র ও অলঙ্কারাদি দিয়ে। ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমু-ল। শিব দিলেন ত্রিশূল। বিষ্ণু দিলেন চক্র। বরুণ দিলেন শঙ্খ। ইন্দ্র দিলেন বজ্র। যম দিলেন দন্ড। হিমালয় দিলেন সিংহ। অস্ত্র ও অলঙ্কারে সুসজ্জিতা দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধ করলেন। দুর্গার আরেক নাম মহিষমর্দিনী। দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত এ যাবত পাওয়া প্রতœ নিদর্শনের মধ্যে দুর্গার মহিষমর্দিনীর সংখ্যা বেশি। দুর্গাম-পের প্রতিমাগুলো দেখলে কৃষি নির্ভর জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সংযোগ উঠে আসে। দুর্গা পরিবারের প্রত্যেকের আছে বাহন। দুর্গার বাহন সিংহ। কার্তিকের ময়ূর। সরস্বতীর হাঁস। লক্ষ্মীর পেঁচা। গণেশের ইঁদুর। পুরাণে প্রতিটি বাহনের তাৎপর্য বর্ণনা করা আছে। দুর্গা পূজায় গণেশ মূর্তির ডান পাশে নয়টি গাছের উপকরণ সংবলিত পাতা রাখা হয়। যাকে বলা হয় নবপত্রিকা। কলা, কচু, ধান, হলুদ, ডালিম, বেল, অশোক, জয়ন্তি ও মানকচু। লাল পাড়ের নতুন শাড়ি দিয়ে নয় পাতাকে সজ্জিত করা হয়। এই নব পত্রিকাকে বলা হয় বসুন্ধরার প্রতীক। যা কলা বউ নামেও পরিচিত। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই দেশে প্রতিমায় দুর্গা পূজার প্রবর্তন করেন রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। এর আগে প-িত রঘুনাথ ‘দুর্গা পূজাতত্ত্ব¡’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তী সময়ে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই পূজাকে জনপ্রিয় করেন। অষ্টাদশ শতাব্দির মধ্যভাগে দুর্গা পূজা সর্বজনের পূজার পরিণত হয়। ১৯০১ সালে বেলুর মঠে জাতি ধর্ম শ্রেণী বিভেদ ভেঙ্গে এই পূজাকে সর্বজনীন রূপ দেন স্বামী বিবেকানন্দ। তারপর দুর্গাপূজা সাগর মহাসাগর পেরিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পুরাণের আরেক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, প্রথমদিকে দুর্গা দেবীর পটে আগমন ছিল সংকোচে। এরপর দুর্গা সকল স্থানে হাজির হন লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশকে নিয়ে। মাথার ওপর থাকে শিব ঠাকুর। দশ ভুজা দুর্গার হাতের ত্রিশূল বধ করে থাকে অসুরকে। এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন বিশ্বের নেতৃবৃন্দ একটি শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছেন। অশুভ শক্তি দমন করে বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠুক এমনটি কামনা করেন পূজার আয়োজকগণ। তারা পূজার সময় দেবী দুর্গার কাছে এমন আবেদন জানাবেন।
×