ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মধুপুরের কোচরা কেমন আছেন?

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১২ আগস্ট ২০১৭

মধুপুরের কোচরা কেমন আছেন?

নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি হারাতে বসেছে আদিবাসী কোচ সম্প্রদায়। অভাব, অনটন আর নানা সমস্যা তাদের পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্য আদিবাসীদের চেয়ে এরা সবকিছু থেকে পিছিয়ে পড়ছে। আদিবাসী কোচ নেতারা জানান, কোচদের আদি নিবাস ভারতের কোচবিহার রাজ্যে। সেখান থেকে তারা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের মধুপুর, সখীপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও গাজীপুরে। এরা হাল্কা-পাতলা সুঠাম গড়নের। চোখ ছোট, মুখম-ল গোলাকার এবং নাক চ্যাপ্টা। কোচদের বেশিরভাগই ফর্সা চেহারার। এক সময় কোচদের নিজস্ব ভাষা ছিল। সে ভাষা তারা হারিয়ে ফেলেছে। টাঙ্গাইলের মধুপুর ও সখীপুরে প্রায় ৬ হাজার কোচ সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। এর মধ্যে শুধু মধুপুরেই রয়েছে ৪ হাজারের অধিক কোচ। এরা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কোচ পুরুষেরা ধুতি ও লুঙ্গি পরে। মেয়েরা পায়ের গোড়ালি থেকে বুক পর্যন্ত ব্যবহার করে তাদের নিজ হাতে তৈরি শাড়ি ও ব্লাউজ। তবে বর্তমানে তারা বাঙালীদের মতো বিভিন্ন ধরনের শাড়িও পরে। এক সময় কোচ মহিলারা নিজেদের পরনের কাপড় নিজেরাই তৈরি করত। তাদের তৈরি কাপড়ের আলাদা একটা ঐতিহ্য ছিল। বিভিন্ন সরঞ্জামাদির মূল্য বৃদ্ধির কারণে তারা কাপড় বুনন বন্ধ করে দেয়। কোচরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। ঘরদোর ও উঠান সব সময় পরিষ্কার থাকে। এরা মূলত কৃষিজীবী। প্রতিটি পরিবারই গবাদিপশু পালন করে। গো-হত্যা নিষিদ্ধ কোচ সমাজে। বাঙালীদের মতো ভাত-মাছের পাশাপাশি তাদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে শামুক, কাঁকড়া, কাছিম, শূকর ও কুইচ্চা। কোচদের পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। ছেলেমেয়েরা মায়ের পরিচয়ে পরিচিতি পায়। একই গোত্রে তাদের বিয়ে হয় না। সাতপাক ঘুরিয়ে বিয়ে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়ে পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে রাজি থাকলে যৌতুকের বিষয়টি চলে আসে। এদের বাল্যবিয়ের প্রচলন বেশি। মধুপুর অঞ্চলে কোচ সম্প্রদায়ের মানুষ অবহেলিত নিগৃহীত। জীবনযাত্রার মানে তারা অনেক পিছিয়ে। জড় পূজায় বিশ্বাসী কোচরা বন-জঙ্গলকে দেব-দেবীর আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করে। এ জন্য তারা বন ধ্বংস ও বিনাশের ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু স্থানীয় বিন বিভাগ কোচ সম্প্রদায়ের অনুভূতি ও বিশ্বাসকে কখনই মর্যাদা দেয়নি। বরং বন ধ্বংস ও গাছ কাটার অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত দায়ের করেছে। মধুপুরের আদিবাসী কোচরা জানান, তাদের বিরুদ্ধে অর্ধশত মামলা রয়েছে। আর এ কারণে সুকুমার চন্দ্র কোচ ও অলস চন্দ্র কোচসহ অনেকেই গ্রাম ও দেশছাড়া হয়েছে। মধুপুর পীরগাছা গ্রামের মমতা রাণী কোচ ও বীণা রানী কোচ জানান, আমরা জমি না থাকার কারণে ব্যাংক ঋণ পাই না। শিক্ষার অভাবে চাকরি পাই না। একই গ্রামের হেমন্ত কোচ বলেন, আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। অশিক্ষার ফলে আমাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের প্রচলন বেশি। কোনভাবেই বাল্যবিয়ে রোধ করা যায় না। পীরগাছা গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র কোচ বলেন, আমাদের আশপাশে কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। জ্বর, সর্দি, ডায়েরিয়া লেগেই থাকে। আশপাশে ভাল কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নেই। কোচ আদিবাসী সংগঠনের নেতা অশুতোষ চন্দ্র কোচ বলেন, অবহেলিত কোচ সম্প্রদায়ের জন্য কোন সরকারই কিছু করেনি। আমরা নিজেদের জমিতে স্থায়ী বসবাসের অধিকার চাই। চাই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। মধুপুর কোচ আদিবাসী সংগঠনের সভাপতি গৌরাঙ্গ চন্দ্র কোচ বলেন, অন্য আদিবাসীদের থেকে মধুপুরে কোচ সম্প্রদায় অনেক পিছিয়ে আছে। শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুবই কম। কৃষিকাজ ও দিনমজুরি আমাদের মূল পেশা। তবে বন বিভাগ বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের হয়রানি করছে। নিজেদের ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে আসছে। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। এ ব্যাপরে টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, সরকার বন নির্ভর জনগোষ্ঠীকে বিশেষ কায়দায় সম্পৃক্ত করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার বনে বসবাসকারীদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক রয়েছে। বন বিভাগ কখনও বন নির্ভর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে না। -ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল থেকে
×