ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

না’গঞ্জে সাত খুন মামলার শুনানি শেষ

আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের রায় ১৩ আগস্ট

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৭ জুলাই ২০১৭

আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের রায় ১৩ আগস্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নারায়ণগঞ্জে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের নিয়মিত ও জেল আপীল এবং ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষ হয়েছে। রায় ঘোষণার জন্য ১৩ আগস্ট দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ বুধবার শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য এ দিন ধার্য করেছেন। আদালতে আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী, এ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, এ্যাডভোকেট মোঃ আহসান উল্লাহ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরোয়ার কাজল ও সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ। শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখার আর্জি পেশ করেন। তিনি বলেন, এই হত্যাকা- ছিল পূর্বপরিকল্পিত। র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মাসুদ রানা ও আরিফ হোসেন পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে আলোচিত এ হত্যাকা- সংঘটিত করেছে। তাই মামলার রায়ের মধ্যে দিয়ে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসে এবং বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। তিনি আরও বলেন, ‘এই হত্যাকা-ের নাটের গুরু নূর হোসেন। তাই তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হতে হবে।’ এই হত্যাকা-ের রায়ে দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রত্যাশা করেন। এদিকে আদেশের পর নিজ কার্যালয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা ক্ষমার অযোগ্য। নিম্ন আদালত আসামিদের যে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়েছে, সেটাই বহাল থাকা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলার শুনানি বুধবার শেষ হয়েছে। আগামী ১৩ আগস্ট রায় ঘোষণার জন্য তারিখ ধার্য করেছেন আদালত। আদালতে আমাদের সাবমিশনে আমরা বলেছি, যে ধরনের খুন এরা করেছে, এটা ক্ষমার অযোগ্য। নিম্ন আদালত তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়েছে, সেটাই বহাল থাকা উচিত। নজরুল ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে নূর হোসেন এই খুনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং পরবর্তী সময় নজরুল ইসলামকে খুন করতে গিয়ে বাকিদের খুন করে ফেলে। এর সঙ্গে একজন আইনজীবীও প্রাণ হারিয়েছেন, যা খুবই দুঃখজনক। এরকমভাবে দিনে-দুপুরে মানুষকে অপহরণ করে নিয়ে যেভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, যে কায়দায় মারা হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদের মারতে হবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সাতদিন আগে। টিম ঠিক করা হয়েছে সাতদিন আগে। যে দিন তাদের মারার জন্য ধরা হবে, সেদিন যে সমস্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে কাজ করানো হবে তাদের নিয়ে গাড়ি রওয়ানা হয়েছে। ধরার বাহানা করে তাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদী নিয়ে ফের নারায়ণগঞ্জ না এনে ট্রলারে করে মেঘনা নদীর মোহনায় ফেলে দেয়া হয়েছে। বস্তাভর্তি ইট, বালু লাশের সঙ্গে বেঁধে তাদের ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল যেন হত্যাকা-ের কোন নিশানাও না পাওয়া যায় এবং লাশ যাতে কোনভাবে ভেসে না উঠে। এ ধরনের প্রিপ্ল্যান এবং সিস্টেমেটিক মার্ডার বাংলাদেশে আগে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’ এর আগে গত ১৭ মে আলোচিত এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ২২ মে সাত খুন মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপীলের শুনানি শুরু হয়। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত নূর হোসেনসহ আসামিদের নিয়মিত ও জেল আপীল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। গত ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত নূর হোসেন, তারেক সাঈদসহ আসামিরা খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করেন। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদ-াদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ আসামির সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। সব মিলিয়ে ৩৫ আসামির মধ্যে কারাগারে আটক আছে ২৭ জন। আর পলাতক আছে ৮ জন। সাজাপ্রাপ্ত ২৫ জন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনী থেকে প্রেষণে র‌্যাবে কর্মরত ছিলেন। অপরাধের সময় তারা সবাই র‌্যাব-১১ তে কর্মরত ছিলেন। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ জন সেনাবাহিনীর, ২ জন নৌবাহিনীর, ৩ জন বিজিবির, ৭ জন পুলিশ ও ২ জন আনসার সদস্য। সাত খুনের মামলার পর তাদের নিজ নিজ বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ২৬ জনের মধ্যে গ্রেফতার ও আত্মসমর্পণ করে ২০ জন নিয়মিত ও জেল আপীল করেন। তারা হলেন মামলার প্রধান আসামি নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মোঃ এমদাদুল হক, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, এস আই পুর্নেন্দু বালা, সিপাহী আসাদুজ্জামান নুর, সৈনিক আব্দুল আলীম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, ল্যান্স নায়েব হীরা মিয়া, আর ও জি এবিএম মোঃ আরিফ হোসেন, নূর হোসেনের ৬ সহযোগী মুর্তজা জামান চার্চিল, আলী হোমাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, আবুল বাশার, রহমত আলী ও জামাল উদ্দিন সরদার। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পলাতক ৬ আসামি আপীল করেননি। তারা হলেন র‌্যাব-১১ চাকরিচ্যুত সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সি, সৈনিক আলামিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম, নূর হোসেনের তিন সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ সান ও সাজাহান। এছাড়া মৃত্যুদ-ের বাইরে বিচারিক আদালত ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের দ- প্রদান করেন। যার মধ্যে রয়েছে কনস্টেবল (পরে এএসআই) হাবিবুর রহমান, এএসআই আবুল কালাম আজাদকে ১৭ বছর, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, কর্পোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন, সিপাই নুরুজ্জামানকে ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমান, হাবিলদার নাসির উদ্দিনকে ৭ বছর কারাদ- প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে দুইজন পলাতক রয়েছেন, তারা হলেন কর্পোরাল মোখলেসুর রহমান ও এএসআই কামাল হোসেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ। পরদিন মেলে আরেকটি লাশ। নিহত অন্যরা হলেন- নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মোঃ ইব্রাহিম। ঘটনার একদিন পর নিহত নজরুলের স্ত্রী বিউটি ও চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দুটি মামলা করেন।
×