ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

গৃহকর্মী নির্যাতন ইতিহাসের দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৫ জুলাই ২০১৭

গৃহকর্মী নির্যাতন ইতিহাসের দায়বদ্ধতা

বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে সফলতা আসছে নানামাত্রিকে। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, অবকাঠামোগত পর্যায়গুলো প্রবৃদ্ধির নির্দিষ্ট গতিধারায় নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবয়ব যখন কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিরন্তর এগিয়ে যেতে থাকে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে যেমন পুরো সমাজে একইভাবে পরিবারের সীমাবদ্ধ গ-িতে। জীবনের স্বাভাবিক মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর পর সংসারে যখন স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে তখনই পরিবারের গৃহকর্তা এবং গৃহিণীর নজরে আসে একজন সাহায্যকারীর। যে মাসোহারার বিনিময়ে তার গৃহে কায়িক শ্রম বিনিয়োগ করবে। এটা যে শুধু আধুনিক কিংবা বিংশ/একবিংশ শতকের প্রচলিত রেওয়াজ তা নয়। সৃষ্টির অনেকটা শুরু থেকে এই প্রচলিত ব্যবস্থা সমাজ এবং পরিবারের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ছিল। আদিম সমাজের সাম্যবাদী ব্যবস্থায় দাস প্রথা অঙ্কুরিত না হলেও পরবর্তী পর্যায়ে এই অমানবিক শৃঙ্খল বিভিন্ন জায়গায় বিস্তার লাভ করে। বিবাদমান গোষ্ঠীর বিভক্ত সমাজে পরাজিতরা সব সময়ই জয়ীদের অধীনে চলে যেত। এভাবে সময়ের ক্রমবিবর্তনের ধারায় আদিম সাম্যবাদী সমাজ রূপ নেয় অমানবিক দাস সভ্যতায়। দাস উৎপাদন পদ্ধতি চরম বর্বরতা আর লোমহর্ষক অধ্যায়ের নিষ্ঠুর পর্যায়। সমাজের সিংহভাগ গোষ্ঠীর পায়ে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে যে অমানবিক যুগের অভ্যুদয় হয়েছিল তা মূলত গড়ে ওঠে প্রাচীন ব্যবলিন গ্রীস আর রোমে। পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা নির্ভর করত দাস শ্রমের ওপর। এদের কোন স্বাভাবিক, সুস্থ জীবন ছিল না। দাস প্রভুদের তৈরি করা দুর্গম খনি আর কৃষি খামারে দাসরা তাদের মূল্যবান শ্রম বিক্রি করে নামেমাত্র খাওয়া পরার বিনিময়ে মালিকদের আজ্ঞাবহ হয়ে জীবন কাটাত। আর বোধহয় সেই কারণে খ্রীস্টপূর্ব ১০ হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠা এই দাস যুগে কোন বরেণ্য মনীষীর লেখায় সমাজের এই নিপীড়িত শ্রেণীর পক্ষে কোন ইতিবাচক বক্তব্য আসেনি। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রীক দার্শনিক প্লটোর ‘আদর্শ রাষ্ট্রে’র নমুনায় সমাজের এই নির্বিত্ত এবং শ্রম বিনিয়োগকারী শ্রেণীর নামটিও আসেনি। প-িতদের ধারণা সিংহভাগ গোষ্ঠীর শারীরিক পরিশ্রমের যে মাত্রাতিরিক্ত পেষণ তার প্রভাব পড়েছিল মননশীলতায়। যার কারণে দাসদের মধ্য থেকে কোন চিন্তাশীল প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব তো দেখাই যায় না এমনকি বিত্ত শ্রেণীর মুষ্টিমেয় প-িতের মধ্যেও দাসদের প্রতি কোন সহানুভূতি কিংবা সহমর্মিতার যথেষ্ট অভাব ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে যে সমাজ পুরো উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে তা হলো আর এক মধ্যযুগীয় বর্বরতা সামন্ত উৎপাদন প্রণালী। এখানে এসেও দাসদের সামাজিক অবস্থার তেমন কোন রদবদল হয়নি। নতুন আঙ্গিকে রূপান্তর ঘটেছে মাত্র। দাসরা হয়ে গেল ভূমির সঙ্গে অচ্ছেদ্য এক ভূমিদাস। তারা এমনই বন্ধনজালে জড়ানো ছিল যে কোন সামন্ত প্রভু তার জমি বিক্রি করলে সঙ্গে সঙ্গে সেই ভূমিদাসও বিক্রীত হয়ে যেত। পাশ্চাত্যে যেভাবে উৎপাদনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে দাস এবং ভূমিদাস প্রথা গড়ে উঠেছিল আমাদের ভারত উপমহাদেশে সে ধরনের কোন ব্যবস্থাই আজ অবধি সমাজ গবেষকরা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে উৎপাদন পদ্ধতিতে সরাসরি যুক্ত না হয়েও এখানে এক ধরনের দাস ব্যবস্থা গড়ে ওঠে যাকে প-িতরা গৃহদাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গৃহদাসরা পরিবার থেকে আরম্ভ করে বৃহত্তর সামাজিক আঙ্গিনায় তার গৃহকর্তা এবং কর্ত্রীর আদেশ পালন করে যেত। আধুনিক শিল্প সভ্যতার যুগে বেশিরভাগ গোষ্ঠী কল-কারখানায় শ্রম বিনিয়োগ করলেও তারা অনেকটাই স্বাধীন। পূর্বেকার সমাজের মতো তার কোন অবিচ্ছিন্নতা থাকে না মালিকের সঙ্গে। সে শ্রম দিতে বাধ্য নয়। কিন্তু জীবিকার তাড়নায় শ্রম বিনিয়োগ করা ছাড়া তার সামনে বিকল্প পথও থাকে না। এই এক অদ্ভুত পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো যেখানে স্বাধীনতার পথ খোলা থাকার পরও ব্যবস্থা এমনই তার অজান্তেই সে নিজের অধীনে না থেকে মালিকের সঙ্গে অবিচ্ছন্ন হয়ে যায়। এ তো গেল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় একজন স্বাধীন শ্রমিকের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেয়া। আর পারিবারিক আবহে গৃহদাসদের অবস্থাও যে কোনভাবেই সুখবর নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা উনিশ এবং বিশ শতকের জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞজনদের লেখায় গৃহকর্মীদের ওপর বিভিন্ন আলোচনা এবং পরিবারে তাদের সুদৃঢ় অবস্থানের কথা জানতে পারি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই শৈশব-কৈশোর কেটেছে ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে। ‘পুরাতন ভৃত্যে’র ওপর কবির একটি কবিতাও আছে। তখনকার দিনে গৃহস্বামীরা তাদের অধীনে থাকা গৃহকর্মীদের জীবনভর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতেন। আমৃত্যু এসব গৃহপরিচারক নিশ্চিন্তে, নির্বিঘেœ জীবন কাটাতে পারত। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তনের হাওয়া। ফলে গৃহকর্মীদের জীবন আর আগের মতো নেই। তখনকার দিনে জমিদার এবং বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তাই পরিবারে গৃহকর্মী রাখার মতো অবস্থায় বিরাজ করতেন। কিন্তু এখন সচ্ছল পরিবারেই এক কিংবা একাধিক সাহায্যকারী রাখা প্রয়োজন হয়। একান্নবর্তী পরিবারে সবাই মিলে মিশে কাজ করত আর সেভাবে সংসারের প্রয়োজনও মিটে যেত। কিন্তু একক পরিবারে এখন আর সেটা সম্ভব নয়। কারণ উন্নয়নের ধারায় মেয়েরাও স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে তাদের ঘর থেকে বের হয়ে বিভিন্ন পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করতে হচ্ছে। আর সম্পন্ন পরিবারের গৃহিণীরা এখন আর সংসারের জন্য শ্রম দিতে মোটেও রাজি নয়। তারা বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাবেÑ আনবে। গান, নাচ এবং আর্ট স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করাতে হবে। এ ধরনের দায়িত্বের গুরুত্ব এখন এত বেশি যে রান্নাবান্না কিংবা ঘর গোছানোর জন্য বাড়তি লোকের সাহায্য ছাড়া আর চলে না। যে সব গৃহকর্মী ছাড়া আজকাল গৃহিণীরা একেবারেই অচল তারাই আবার কাজের সামান্য হেরফেরে চড়াও হয় প্রতিমুহূর্তের সাহায্যকারীর ওপর। এসব গৃহকর্মীর মধ্যে সিংহভাগই নারী। সেখানে অবোধ বালিকা থেকে কিশোরী এমনকি ঠিকা হিসেবে মধ্যবয়সী, প্রৌঢ়া এবং বৃদ্ধারাও থাকে। এসব ক্ষেত্রে গৃহকর্তার চাইতে কর্ত্রীরাই বেশি খবরদারিতে নিজেদের নিয়োগ করেন। তিনিও আবার রক্তে, মাংসে গড়া একজন নারী। যেসব গৃহপরিচারিকা সংসারের প্রতিটি কাজে বেগম সাহেবকে সাহায্য করে যায় তার ওপর নৃশংস আক্রমণ চালাতে কর্ত্রীর একটুও হাত কাঁপে না। যাদের ছাড়া এক দ-ও চলা যায় না তাদের ওপর এমন কদর্য অত্যাচার আমাদের সভ্যতাবিবর্জিত বর্বর যুগে নিয়ে যায়। পর পর ঘটে যাওয়া অনেক গৃহকর্মীর ওপর সহিংস আচরণ গণমাধ্যমে উঠে আসে। মামলা করা হয়, অভিযুক্ত আটকও হন। কিন্তু যেহেতু সম্পন্ন, অভিজাত ঘরের গৃহবধূ সেহেতু তিনি আইনের ফাঁক ফোকরে বেরিয়েও আসেন। পরিবারে যখন গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন চালানো হয় তখন পুরো পরিবেশ কি সুস্থ আর স্বাভাবিক থাকে? গৃহস্বামীর সন্তানদের ওপর কি এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বর্তায় না? সন্তানদের বেড়ে ওঠা আর জীবন গড়ার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে এমন নির্মমতার চিত্র কি তাদের বিভ্রান্ত করবে না? নিজের সন্তান ভাল-মন্দের বোধটুকুও হারাতে বসবে। সামান্য কারণে মারামারি, কাটাকাটিতে সন্তানরা অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে যা নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় জীবনকে সুস্থ ধারায় বিকশিত হতে দেবে না। যে কোন মানুষের তার গৃহকর্মীর কাজ কিংবা আচার ব্যবহার পছন্দ নাও হতে পারে। তাহলে তাকে বাদ দিয়ে দিতে হবে পরিবেশ সুস্থ রাখার জন্য। তাকে শারীরিকভাবে জখম করার অধিকার কাউকেই দেয়া হয়নি। আইন, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম প্রত্যেক মানুষের অধিকারের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এসব বিধিনিষেধ মেনে চলা প্রত্যেকের দায়িত্ব। সম্প্রতি আদুরির ওপর হয়ে যাওয়া নির্যাতনের বিচারের রায়ে অপরাধীর প্রাপ্য শাস্তি হয়েছে। তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে সর্বাত্মক প্রতিরোধে বন্ধ করার জোরালো পদক্ষেপ নেয়া সব থেকে বেশি জরুরী। এমন নৃশংস মামলা যেন কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে না পারে তার একটি সুষ্ঠু সমাধান এখনই দরকার। কারণ প্রতিরোধের চাইতে প্রতিষেধকই উপযুক্ত ব্যবস্থা। যে কোন উপায়ে এই অমানবিক নৃশংসতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতেই হবে। লেখক : সাংবাদিক
×